চাঁদের বুড়ির বয়স যখন ষোলো (হার্ডকভার)

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

    বাংলাদেশের বাঙালী জাতির ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, বিগত সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে আমরা বিশ্বাসঘাতকার দরুন বহিরাগতদের আক্রমণে বারবার পর্যদস্ত ও পরাজিত হয়েছি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে ও মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তর থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বে গােপন ষড়যন্ত্র হয়েছিলাে। কিন্তু মুজিবনগরের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের তৎপরতা এবং ভারত সরকারের সহযােগিতায় এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা সম্ভব হয়েছিলাে। এছাড়া অতীতের হাজার বছরের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার দরুন গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় বাঙালী জাতির ভাগ্যে শুধুমাত্র পরাজয়ের গ্লানি। আর এসব গ্লানি ও পরাজয়ের ইতিহাস দেশী ও বিদেশী ইতিহাসবিদরা নানাভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। শুধু তাই-ই নয়, বুদ্ধিজীবীরাও এসব পরাজয়ের ইতিহাসকে ভিত্তি করে অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র ও কবিতা রচনা করেছেন। অথচ আমাদের ইতিহাসে একমাত্র বিজয় একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ভিত্তি করে তেমন কোনাে সাহিত্য রচিত হয়নি। উপরন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের একটা সঠিক ইতিহাস পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয়নি। সর্বত্র হিসাবের গরমিল এবং বিকৃত ইতিহাস রচনার প্রবণতা। এমনকি সুষ্ঠু গবেষণার ব্যবস্থা পর্যন্ত অনুপস্থিত। তা হলে কেন এমনটি হলাে? | আমরা যাদের বামপন্থী কিংবা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করে গর্ব অনুভব করি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কম্যুনিস্ট চীনের ভূমিকার দরুন এঁদের অংশবিশেষের মধ্যে ১৯৭১ সালে এই যুদ্ধ সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকায়, এঁরা এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে সযত্নে দূরে সরে ছিলেন কিংবা বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছিলেন। ফলে বাঙালী জনগােষ্ঠীর রক্তাক্ত যুদ্ধ এবং বাঙালীর মনমানসিকতার সঙ্গে এসব বুদ্ধিজীবীর কোনােই যােগাযােগ ছিলাে না। এসব বুদ্ধিজীবী আশ্চর্যজনকভাবে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভে বঞ্চিত হয়েছেন। এটা এক বিরাট ট্র্যাজেডি’। কারণ একটাই এবং তা’ হচ্ছে ১৯৭১ সালে পাক-চীন-মার্কিন সখ্যতা। | দ্বিতীয় বুদ্ধিজীবী গােষ্ঠী ছিলাে ধর্মান্ধ এবং ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল। এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। তাই এরা বাঙালী গণহত্যাকে অস্বীকার করে দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয়া ছাড়াও সরাসরিভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মদ যুগিয়েছেন। আশ্চর্যজনকভাবে এদের অধিকাংশই পেশায় শিক্ষক ও শিল্পী। অবশ্য এদের সংখ্যা অতি নগণ্য। এরা বাংলাদেশের বাঙালী জাতির কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন। এদের জীবনের ইতিহাস হচ্ছে স্বৈরাচার ও খুনী শাসকগােষ্ঠীর পদলেহন ও জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। অবশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সবাই এসময় হয় ঢাকায়, আর না হয় মুজিবনগরে অবস্থান করছিলেন। যেসব বুদ্ধিজীবী ঢাকায় ছিলেন, মােটামুটিভাবে অসুবিধায় থাকলেও এরা প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে চাকরিতে যােগদান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা করেছিলেন। অথচ এসময় সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক সরকারী কর্মচারী ‘ডিফেক্ট’। করেছিলাে। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে এসব বুদ্ধিজীবী চাকরিতে লিপ্ত থাকা: এঁদের পক্ষে গ্রামবাংলায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ ও নারী নির্যাতনের বীভৎস কর্মকাণ্ড কিংবা এর বিপরীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ লড়াই, কিছুই দেখা সম্ভব হয়নি। মহল বিশেষের মতে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এসব বুদ্ধিজীবীর ‘পলায়নী মনােবৃত্তি’র বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলাে প্রকটভাবে। ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি এদের নৈতিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও এঁরা যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। | সত্যিকারভাবে বলতে গেলে যে বিপুল সংখ্যক শ্রদ্ধাভাজন বুদ্ধিজীবী দুর্গম পথ অতিক্রম করে মুজিবনগরে গিয়েছিলেন, তারা প্রবাসী সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। এরা সভা, শােভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, সেমিনার, চিত্রপ্রদর্শনী ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে নানাভাবে প্রচার ও প্রােপাগাণ্ডায় লিপ্ত ছিলেন। এমনকি এঁরা শরণার্থী শিবিরগুলােতে পর্যন্ত নিয়মিতভাবে যাতায়াত করেছিলেন। কিন্তু এদের কেউই একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করা তাে দূরের কথা, রণাঙ্গন পর্যন্ত পরিদর্শন করেননি। এঁরা কেউই রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের লড়াই দেখেননি কিংবা রাজাকার, আলবদর এবং পাকিস্তানী রাজাকার বাহিনী নারকীয় কর্মকাণ্ড অবলােকন করেননি। এঁরা জীবনের দুর্লভ অভিজ্ঞতা লাভে বঞ্চিত হয়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব বুদ্ধিজীবী এবং গ্রামবাংলার জনগােষ্ঠীর মধ্যে চিন্তাধারার বিরাট ব্যবধানের সৃষ্টি | হয়েছে। আর এই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার পর যখন সমগ্র জাতি প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছােটগল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রের জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলাে, তখন বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবে আমাদের লেখক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ জাতির সেই চাহিদা মেটাতে পারেন। বরং মুক্তিযােদ্ধাদের “আবার তােরা মানুষ হ” অর্থাৎ রাজাকার হবার উপদেশ | দিয়েছেন। এর চেয়ে লজ্জার ব্যাপার আর কি হতে পারে? ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় নয়াদিল্লীতে ১৮ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর নাগাদ এক আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী সম্মেলনের আয়ােজন করা হয়েছিলাে । বিশ্বের ২৪টি দেশের ১৫০ জনের মতাে বুদ্ধিজীবী এই সম্মেলনে যােগ দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে সােচ্চার হয়েছিলেন। প্রখ্যাত ফরাসী মনীষী আঁন্দ্রে মারােকে এই সম্মেলনের জন্য আমন্ত্রণলিপি পাঠানাে হয়েছিলাে। তিনি অপারগতার কথা জানিয়ে এক চমক্কার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি এমর্মে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর বয়স এখন সত্তরের ঊর্ধ্বে। এসময় প্যারিস থেকে বিমানে দিল্লী যাওয়ার ধকল সহ্য করার মতাে যদি তার শারীরিক সামর্থ্য থাকতাে, তাহলে তিনি আরও কিছুদূর এগিয়ে অস্ত্র হাতে বাংলাদেশের রণাঙ্গনে বাঙালী মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই-এ অংশ গ্রহণ করতেন। এতে অন্তত এই বয়েসেও তার জীবনের অভিজ্ঞতায়। একটা নতুন অধ্যায় সংযােজিত হতাে। বর্তমান শতাব্দীর তিরিশ দশকে হিটলারের দোসর ফ্যাসিস্ট ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে স্পেনের বিপ্লবের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গণতন্ত্রের আদর্শকে সমুজ্জ্বল রাখার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক যােগদান করেছিলাে। এঁদের মধ্যে বৃটেনের শ্রমিক নেতা এটলী (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী) এবং প্রখ্যাত মার্কিনী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে অন্যতম ছিলেন। হেমিংওয়ে এসময় সুদূর আমেরিকা। থেকে স্পেনে আগমন করে ডিক্টেটর ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ফসল হচ্ছে বিশ্ব সাহিত্যের অমর সৃষ্টি ‘ফর হুম্ দি বেল টলস’।
Cash On Delivery
7 Days Happy Return
Delivery Charge Tk. 50(Online Order)
এম আর আখতার মুকুল
(জন্ম: ৯ আগস্ট, ১৯৩০ - মৃত্যু: ২৬ জুন, ২০০৪) একজন বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের চরমপত্রের পরিচালক, লেখক ও কথক ছিলেন। 'চরমপত্র' অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সাহস, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল৷ সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার থেকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন। তিনি একজন কলামিষ্ট৷ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৫টি৷ আর আখতার মুকুল ১৯৪৫ সালে দিনাজপুর মহারাজা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি দিনাজপুর রিপন কলেজ(ব্রাঞ্চ) থেকে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৭ সালে৷ ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তিনি ১৯৪৮ সালে জননিরাপত্তা আইনে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং ১৯৪৯ সালে জেলখানা থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করেন৷ ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন৷[৩] ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈঠকের সময় যে ১১ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত হন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। অন্যান্যরা ছিলেন ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ সুলতানা, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমিন, এস এ বারী এটি, সৈয়দ কামরুদ্দীন হোসেইন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর হোসেন, আনোয়ার হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এম আর আখতার মুকুল সাংবাদিকতা পেশায় যোগদান করেন৷ সাপ্তাহিক 'নও বেলাল', 'পাকিস্তান টুডে' , দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক সংবাদ ইত্যাদি পত্রিকায় তিনি কাজ করেন। ১৯৫৩ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ইত্তেফাকের জন্মলগ্ন থেকে ১৯৬০ সালের জুলাই পর্যন্ত এই পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন৷ ১৯৬১ সালের শেষের দিক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এম আর আখতার মুকুল আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইউডিআই-এর ঢাকাস্থ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন৷ একই সঙ্গে তিনি ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকায় এবং পরে দৈনিক পূর্বদেশেও চাকুরী করেন৷ এম আর আখতার মুকুল ১৯৭১ সালে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে যোগদান করে তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে তিনি বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান৷ ১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়রি তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলর হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে এম আর আখতার মুকুল দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে যোগদান করেন৷ ১৯৮৭ সালের আগস্ট মাসে তিনি সরকারি চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন৷

এই লেখকের আরো বই