চাঁদের বুড়ির বয়স যখন ষোলো (হার্ডকভার)

মুজিবের রক্ত লাল

    ‘মুজিবের রক্ত লাল’ বিশিষ্ট সাংবাদিক এমআর আখতার মুকুলের লেখা অসামান্য বইটি আলোচনা করার আগে, ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনের একটা সাক্ষাৎকারের নমুনা দিয়ে শুরু করতে চাই। এ নমুনা সাক্ষাৎকারের ভেতর দিয়ে ১৯৭১, বাংলাদেশ, শেখ মুজিব এবং আরব দেশের ঠিকুজি বুঝতে সহজ হবে। ১৯৭৩ সালে সৌদি আরবের বাদশাহ ছিলেন ফয়সল। সাক্ষাৎকারের সময়ে দুজনের মধ্যে আলাপ চলছে- বাদশাহ : আমি শুনেছি যে, বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে কিছু সাহায্যপ্রত্যাশী। কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনারা কোন ধরনের সাহায্য চান? অবশ্য সাহায্য দেয়ার জন্য আমাদের কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। মুজিব : মি বাদশাহ, বেয়াদবি নেবেন না। আমি হচ্ছি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আমার তো মনে হয় না, মিসকিনের মতো বাংলাদেশ আপনাদের কাছে কোনো সাহায্য চেয়েছে? বাদশাহ : তাহলে আপনারা কিংডম অব সৌদি আরবের কাছ থেকে কী চাচ্ছেন? মুজিব : বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র কাবা শরিফে নামাজ আদায়ের অধিকার চাচ্ছে। আপনিই বলুন পবিত্র কাবাঘরে নামাজ পড়ার জন্য কোনো শর্ত থাকতে পারে কি? আপনি সুমহান এবং প্রতিটি বাঙালি মুসলমান আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপনি হচ্ছেন কাবা শরিফের হেফাজতকারী। এখানে দুনিয়ার মুসলমানের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। সেখানে আবার শর্ত কেন? এক্সেলেন্সি, আমরা আপনাদের কাছ থেকে ভ্রাতৃসুলভ সমান ব্যবহার প্রত্যাশা করছি। বাদশাহ : এসব তো রাজনৈতিক কথা হল না। এক্সেলেন্সি, বলুন আপনারা সৌদি কিংডম অব অ্যারাবিয়ার কাছ থেকে কী চাচ্ছেন? মুজিব : এক্সেলেন্সি, আপনি জানেন এ দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। আমি জানতে চাচ্ছি, কেন সৌদি আরব আজও পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না? বাদশাহ : আমি পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা ছাড়া আর কারও কাছে জবাবদিহি করি না। তবুও আপনি একজন মুসলমান, তাই বলছি সৌদি স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ করতে হবে। মুজিব : এ শর্তটা কিন্তু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এ দেশে প্রায় এক কোটির মতো অমুসলিম রয়েছে। সবাই একসঙ্গে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে হয় শরিক হয়েছে, না হয় দুর্ভোগ পোহায়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তো মুসলমানদের আল্লাহ নন, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র অধিকর্তা। তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র স্রষ্টা। এক্সেলেন্সি, বেয়াদবি মাফ করবেন, আপনাদের দেশের নামও তো ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব সৌদি অ্যারাবিয়া’ নয়। এ মহান দেশের নাম আরব জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও রাজনীতিবিদ মরহুম বাদশাহ ইবনে সৌদের সম্মানে ‘কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া’। কই আমরা তো কেউ এ নামে আপত্তি করিনি। বাদশাহ : এক্সেলেন্সি, এ ছাড়া আমার অন্য একটা শর্ত রয়েছে এবং তা হচ্ছে অবিলম্বে সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিতে হবে। মুজিব : এক্সেলেন্সি, এটা তো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। দুটি দেশের মধ্যে এ ধরনের আরও অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ পাকিস্তানি নাগরিকের দেশে ফিরিয়ে নেয়া, বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করা। এ সবের মীমাংসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শুধু বিনাশর্তে ৯১ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নটি পৃথকভাবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। আর এ জন্য সৌদি আরবই বা এত উদ্গ্রীব কেন? বাদশাহ : এক্সেলেন্সি, শুধু একটুকু জেনে রাখুন সৌদি আরব আর পাকিস্তান একই কথা। পাকিস্তান আমাদের সবচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধু। তাহলে এক্সেলেন্সি, আর তো কথা থাকতে পারে না। আমাদের শর্ত দুটির বিষয়ে চিন্তা করে দেখবেন। ...। শর্ত পূরণ করলে বাংলাদেশের সাহায্যের কোনো কমতি হবে না। মুজিব : একটা বিষয়ে বুঝিয়ে বললে খুশি হতাম। বাদশাহ : বলুন, কী বিষয়? মুজিব : প্রায় দু’বছর পর্যন্ত সৌদি আরব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ায় পরহেজগার মুসলামানরা যে পবিত্র হজ আদায় করতে পারছে না, সে কথা ভেবে দেখেছেন কি এক্সেলেন্সি? এভাবে বাধা দেয়া কি জায়েজ হচ্ছে? পবিত্র কাবা শরিফে তো দুনিয়ার সব দেশের মুসলমানদের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। আজ কেন হাজার হাজার বাঙালি পরহেজগার মুসলমানকে ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে পবিত্র হজ পালন করতে হচ্ছে? মুজিবের এ প্রশ্ন উত্থাপনের পর হঠাৎ করেই আলোচনার সমাপ্তি ঘটে। একাত্তর সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, লড়াই কি কেবল বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল? যারা গড়পড়তার সীমাবদ্ধ চিন্তা করেন তারাই এ সীমাবদ্ধ ভাবনায় ডুবে থাকতে পারেন, ডুবে থাকতে ভালোওবাসেন। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে দুনিয়ার অনেক দেশ, দেশের নেতাও জড়িত হয়েছিল। এমআর আখতার মুকুলের লেখা ‘মুজিবের রক্ত লাল’ পুস্তকের ৪২-৪৩ পৃষ্ঠার মুজিব আর সৌদি বাদশাহ ফয়সলের ইন্টারভিউ থেকে বুঝতে পারা যায় খুব সহজে। এবং এটাও বুঝতে পারা যায়, ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে সৌদি আরব কত দ্রুত পরবর্তী খুনি সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি কেবল উপমহাদেশের রাজনীতির ঘোরাটোপে বন্দি কোনো অনুষঙ্গ নয়, এ ছিল ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন পর্যস্ত বিস্তৃত এক জটিল অঙ্কের জাল, কারও কারও ব্যক্তিগত পরাজয়ের শোধ তোলার ঘৃণ্য ইচ্ছার নগ্ন প্রকাশও। কীভাবে কেমন করে কোন কোন দেশের সহায়তায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এ নির্মম ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সেসব অজানা ঘটনার চমৎকার ও সাবলীল বর্ণনার ভেতর দিয়ে এমআর আখতার মুকুল লিখেছেন অনন্য ঐতিহাসিক প্রামাণ্য বই ‘মুজিবের রক্ত লাল’। বইটির ভেতরে এমনসব তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন সেই সময়ে, ১৯৭৬ সালে যা বিস্ময়কর। আর তথ্যগুলো আমাদের অনেকটাই অজানা। এ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে জাতির জনকের মৃত্যুর পরের বছর, ১৯৭৬ সালে, লন্ডন থেকে। কারণ, এমআর আখতার মুকুল তখন জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে ব্রিটেনে থাকতেন। যদিও সেখানে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে, বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকতা হিসেবে। কিন্তু জনকের মৃত্যুর পর দূতাবাসের চাকরি আর থাকেনি স্বাভাবিকভাবেই। আমার ধরণা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এমআর আখতার মুকুলের লেখা এ বইটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রথম বই। সেদিক থেকে তিনি পথিকৃত। এমআর আখতার মুকুল ‘মুজিবের রক্ত লাল’ গ্রন্থের প্রথম প্রকাশের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যকে বিনষ্ট করার জন্য বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের সমর্থনে এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। ‘মুজিবের রক্ত লাল’ পুস্তকে মোটামুটিভাবে এ হত্যাকাণ্ডের পটভূমি বর্ণনা করা ছাড়াও কীভাবে হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার বিবরণও দেয়া হয়েছে। নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে পুরো ব্যাপারটা পাঠকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পর্দার অন্তরালে যারা অত্যন্ত সঙ্গোপনে ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন, তাদের ভূমিকা প্রকাশ করতে হলো। ভবিষ্যতে ঐতিহাসিকরা এসবের সত্যতা সঠিকভাবে নিরূপণ করবেন। সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়াটাও ছিল মস্ত ঝুঁকির এবং দুরন্ত সাহসের ঘটনা। সে দুঃসময়ে এমআর আখতার মুকুল অসাধারণ সাহস ও দৃঢ়তা দেখিয়েছেন এবং ‘মুজিবের রক্ত লাল’ গ্রন্থ প্রকাশ করে খুনিদের, ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার পরের বছরই লন্ডন থেকে বইটি প্রকাশ করেছেন। আরব ও আরব দেশের মানুষ সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের এক ধরনের অর্থহীন আনুগত্য আছে, এ আনুগত্যের পেছনে ধর্ম অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করছে। কিন্তু আরব দেশের রাজা-বাদশাহরা, এমনকি শেখরা দুনিয়ার কোনো মানবিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে? তেল বিক্রির টাকায় দুনিয়ার যাবতীয় অপকর্ম করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিজেদের সত্তা বিকিয়ে দিয়ে, এক যাযাবর উপনিবেশ নিজেরাই তৈরি করেছে। আর সব জায়গায় পবিত্র ধর্ম ইসলামকে ব্যবহার করছে, বিক্রি করছে। নইলে একাত্তরে আমাদের ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে মুখ বুজে থাকতে পারে? কেবল কি মুখ বুজে ছিল? পাকিস্তানি হায়েনা বাহিনীর সমর্থক ছিল। পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের দরিদ্র দেশটাকে জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছিল, লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন করছিল, সেই সময়ে গোটা আরব এলাকা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। অথচ ইসলাম দুনিয়ায় সাম্য ও মহত্ত প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিল, সেই ধর্মের নামে মানুষ হত্যা সমর্থন করতে পারে আবর দেশগুলো? অথচ একাত্তরে সেটাই আরব দেশগুলো করেছে। আমাদের দেশের মোমিন মুসলমানদের পবিত্র হজযাত্রা থেকে বঞ্চিত করেছে। নিজেদের দেশের নাম ইসলামিক প্রজাতন্ত্র না রেখে আমাদের দেশের নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র রাখতে নসিহত করে- এসব সূত্র থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর পরই হত্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারকে সমর্থন দিয়ে প্রমাণ করেছে, আরব দেশের মানুষেরা, রাজারা জনগণের পক্ষে নয়। তারা নিরেট ক্ষমতার পক্ষে, আর ধর্ম ক্ষমতায় থাকার মহান রজ্জু। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৌদি বাদশার সাক্ষাৎকারের ভেতর দিয়ে তা প্রমাণিত। এ কারণেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের গোটা ভূগোল বোঝানোর জন্য অবাক সাক্ষাৎকার দিয়ে লেখাটা শুরু করলাম। যাতে, পাঠক প্রকৃত বার্তা পান। ‘মুজিবের রক্ত লাল’ বইটি তিনশ পৃষ্ঠাও বেশি। গোটা বইয়ের অনুপুঙ্খ আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু পাঠক যাতে বুঝতে পারেন, বইটির মাহাত্ম, বুঝতে পারেন এ বইটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সে কারণে সূচিপত্র উপস্থাপন করছি। এমআর আখতার মুকুল জাতে ছিলেন সাংবাদিক। লেখার হাতও ঝরঝরে, বলিষ্ঠ আর স্পষ্ট। নিজে যা বিশ্বাস করতেন, অকপটে বলতেন। বাক্য গঠনে নিজস্ব ক্যারিশমা আছে। মনে পড়ে- ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার রচিত ও পঠিত ‘চরমপত্র’র আখ্যান। নিজের কণ্ঠকে অন্য ফোকাসে নিয়ে, বাক্যর মধ্যে পুরান ঢাকার শব্দ প্রবেশ করিয়ে নিজের মতো করে আলাদা একটি স্টাইল তৈরি করেছিলেন। যা সেকালের বিক্ষত বাঙালির মনে প্রবল আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। সেই মুকুল যখন তার আরাধ্য নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লিখবেন বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ গ্রন্থ, সেই বইয়ের ঘটনাপ্রবাহ পরিপ্রেক্ষিত তো অন্যরকম হবেই। ঘটনাপ্রবাহের আলোকে ‘মুজিবের রক্ত লাল’ সূচিতে প্রবেশ করতে চাই। যদিও বইয়ের শুরুতে প্রচলিত যে সূচি থাকে, নির্দিষ্ট করে সেই সূচি তিনি তৈরি করেননি। শিরোনামের পর শিরোনামে মুজিবের সঙ্গে সম্পর্কের বুননের সঙ্গে ইতিহাসের নানা তথ্য উপাত্তে সাজিয়ে বইটিকে মহার্ঘ্য করে তুলেছেন। সূচি- এক, লন্ডনে মুজিব হত্যার সংবাদ কীভাবে পৌঁছল। দুই, আলজিয়ার্সে বঙ্গবন্ধু-সিহানুক বৈঠক : মার্কিনিদের ভ্রমাত্মকনীতির খেসারত। তিন, আল্লাহতায়ালা তো শুধু আল মুসলেমীন নন, তিনি রাব্বুল আলামীনও- মুজিব। চার, এক্সেলেন্সি মুজিব, আপনি কিন্তু নিশ্চিত হতে যাচ্ছেন- ক্যাস্ট্রো। পাঁচ, বটগাছ পইড়্যা গেলে হাওয়ার দাপট টের পাইবেন- বঙ্গবন্ধু। ছয়, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের কৃতিত্ব শেখ মুজিবের। সাত, মুজিবের হত্যাকারী মেজর নূর- ম্যাসকার্নহাস, মুজিবের ঘাতক সুবেদার মোসলেম- লিফসুজ। আট, টনি ম্যাসকার্নহার্স, মেজর ফারুক আর মেজর রশিদের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত। নয়, ম্যাসকার্নহাসের লেখনীতে সপরিবারে প্রেসিডেন্ট মুজিব হত্যার বীভৎস কাহিনী। দশ, হত্যাকাণ্ডের সময়ে মার্কিন দূতাবাসের গাড়ি ঢাকার রাস্তায় ছোটাছুটি করছিল। এগারো, একশ্রেণির সাংবাদিকের অর্থবহ ভূমিকা, লিফসুজের লেখনীতে ষড়যন্ত্রের কথাবার্তা। বারো, ষড়যন্ত্রের কথা জানতে হলে প্রথমেই আওয়ামী লীগের জন্মকথা। তেরো, মুখে সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও মুজিব আমলে ব্যুরোক্রেসির মারপ্যাঁচ। চৌদ্দ, ৭৪ এ তাজউদ্দীনের পদত্যাগ : মুজিবের কোমর থেকে শাণিত তরবারি অপসারিত। পনেরো, বাকশালের জন্ম : আওয়ামী লীগের মতো কমিউনিস্ট পার্টির বিলুপ্ত। ষোলো, প্রেসিডেন্ট মুজিব হত্যা : লন্ডন টিভিতে ফারুক রশিদের প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি। সতেরো, লন্ডন ষড়যন্ত্র : মোশতাক এবং চীনাপন্থীদের হাইকমিশন আক্রমণ। আঠারো, পরিশিষ্ট। উনিশ, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি যেমনটি দেখেছি। ওপরের সূচি বিন্যাস থেকেই বুঝে নেয়া যায়, গ্রন্থের ভেতরের শাঁস। যেমন মুখে সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও ব্যুরোক্রেসির মারপ্যাঁচ শিরোনামের শুরুতেই এমআর আখতার মুকুল লিখেছেন- ‘পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ব্রিটেনের দু’শ বছর এবং পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসন ও শোষণ এর জন্য দায়ী। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়া তো দূরের কথা, দিনদিন অবনতি হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের জবাবে নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, বাংলাদেশের ব্যুরোক্রেসিই এর জন্য মূলত দায়ী। স্বাধীনতার পর পরই যেদিন অফিসারদের চাকরি অব্যাহত রেখে পাকিস্তানি যুগ থেকে সিনিয়রিটি দেয়ার সিদ্ধান্ত হল সেদিনই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বানচাল করে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করার বীজ বপন করা হল।’ স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশে অনেক অবাক করা ঘটনা ঘটেছে। নতুন দেশ, নতুন সরকার, দেশে বেকার দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে- বঙ্গবন্ধু দিশেহারা, ঠিক এ সময়ে গোপনে বেড়ে উঠেছে গোক্ষুর। যেই গোক্ষুরের সন্ধান সেই সময়ে কেউ করেনি। এমআর আখতার মুকুলের এ লেখার ভেতর দিয়ে নতুন করে উদ্ভাসিত হল..। ‘মুজিবের রক্ত লাল’ বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় তিনি প্রচুর তথ্যর সমাবেশ ঘটিয়েছেন। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। গোটা বই আদ্যোপান্ত পাঠ করে আমার মনে হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট মুজিব হত্যা : লন্ডন টিভিতে ফারুক রশিদের প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি’ এই সাক্ষাৎকারটা বাংলাদেশের ইতিহাসের মোচড়ে বড় একটি দাগ। কেননা, এ সাক্ষাৎকারের ভেতর দিয়ে ফারুক ও রশিদের সব কর্মকাণ্ডের একটি নিখুঁত খতিয়ান উঠে এসেছে। নির্মম হত্যার আগে ওরা কোথায় কোথায় কার সঙ্গে কবে এ বিষয়ে কথা বলেছে, সময় তারিখ মিলিয়ে আদ্যোপান্ত জানা যায়- এ দুই খুনির মুখ থেকে। সাক্ষাৎকারের শুরুতে এমআর আখতার মুকুলের ছোট্ট একটা ভূমিকা আছে, যে ভূমিকা পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের মানুষের মনে তথাকথিত ক্লিন রাজনীতির একজন জেনারেল সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। এমআর আখতার মুকুল লিখেছেন- ‘এসব কর্মকাণ্ডের মাত্র নয় মাস পর ১৯৭৬ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের আলোচ্য মেজরদের নেতা ফারুক ও রশিদ এক চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকার প্রদান করে। এ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলেন উপমহাদেশের বিতর্কিত সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস। এক পশ্নের জবাবে ফারুক-রশিদ সপরিবারে প্রেসিডেন্ট মুজিব হত্যার কথা স্বীকার করল এবং বলল যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্রের কথা অভিহিত ছিলেন।’ এই জেনারেল কীভাবে কেমন করে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যার পেছনের কুশিলব হল, জানতে হলে গোটা সাক্ষাৎকারটাই পাঠকদের পাঠ করা দরকার। গোটা সাক্ষাৎকার কোথায় আছে? এমআর আখতার মুকুলের বই ‘মুজিবের রক্ত লাল’-এ পাবেন। এ ধরনের আরও অনেক অজানা তথ্য এ বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে রেখেছেন মুকুল। ‘মুজিবের রক্ত লাল’ গ্রন্থে প্রথমবারের মতো দেখতে পেলাম ও পাঠ করলাম- খন্দকার মোশতাকের ইনডেমনেটি আইন বাংলার রূপান্তরিত করেছেন গ্রন্থকার। মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের তালিকাও দিয়েছেন লেখক। মুজিব, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ- বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য ‘মুজিবের রক্ত লাল’ বইটি পূর্ণ। বিশেষ করে পরিশিষ্ট পর্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও অনেক ঘটনা উপস্থাপন করেছেন এমআর আখতার মুকুল। ফলে, বইটি একটি বিশেষ সময় অতিক্রম করেও বাঙালির কাছে পৌঁছে যাবে। পরিশিষ্টের সূচি থেকে কয়েকটি সূচি : আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে : স্বাধীনতা অথবা শেখ মুজিব -খন্দকার মোশতাক, কার্নেগি দলিলপত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির চরম পরাজয়, হেনরি কিসিঞ্জারের সহকারী রজার মরিসের চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকার, সৈয়দ আলী আহসানের লিখিত বিবৃতিতে বিতর্কিত তথ্য, একাত্তরে দখলদার সরকারের সমর্থনে ঢাকায় ৫৫ বুদ্ধিজীবীর বিবৃতিসহ আরও আরও অনেক তথ্য তত্ত্ব যে কোন পাঠককে অনেক প্রশ্নের উত্তরে আরও প্রশ্নের জন্ম দেবে। বাংলাদেশের ইতিহাসের আলেখ্যে অসামান্য বইটি, এমআর আখতার মুকুলের লেখা ‘মুজিবের রক্ত লাল; সর্বশেষ প্রকাশিত হয়েছে ২০০০ সালে। তখনও ‘চরমপত্র’খ্যাত এমআর আখতার মুকুল বেঁচে আছেন। তিনি পঞ্চম মুদ্রণের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘প্রথম প্রকাশের দীর্ঘ তেরো বছর পর ১৯৮৯ সালে ঢাকা থেকে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত আকারে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করি। এতে বহু গবেষণালব্ধ তথ্য সংযোজন করেছি। উপরন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় কারা কোন ধরনের ভূমিকা পালন করেছে, তারও প্রামাণ্য তথ্যাদি সংযোজন করেছি।...সবশেষে ‘মুজিবের রক্ত লাল’ বইটির চাহিদা অব্যাহত থাকায় নতুন শতাব্দীতে এসে পঞ্চম মুদ্রণ প্রকাশ করলাম। ...জয় বাংলা, খোদা হাফেজ। এমআর আখতার মুকুল বেঁচে নেই। কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টিতে যেমন তিনি রেখেছেন অনন্য ভূমিকা, তেমনই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায়ও তিনি অগ্রগামী। যখন এ দেশে- মুজিব সম্পর্কে কোনো পুস্তক প্রকাশ করা ছিল অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ, তখন তিনি প্রকাশ করে দেখিয়েছেন সাহসের স্পর্ধা- ‘আমি বিজয় দেখেছি’। চেতনার অগ্নিলেহনে তিনি অজস্র পুস্তক রচনা করেছেন। সমাজ দেশ রাষ্ট্র ও চরিত্রকে নিজের মতো করে মূল্যায়ন করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন- কিন্তু মুজিব আদর্শ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। মনি হায়দার
Cash On Delivery
7 Days Happy Return
Delivery Charge Tk. 50(Online Order)
এম আর আখতার মুকুল
(জন্ম: ৯ আগস্ট, ১৯৩০ - মৃত্যু: ২৬ জুন, ২০০৪) একজন বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের চরমপত্রের পরিচালক, লেখক ও কথক ছিলেন। 'চরমপত্র' অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সাহস, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল৷ সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার থেকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন। তিনি একজন কলামিষ্ট৷ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৫টি৷ আর আখতার মুকুল ১৯৪৫ সালে দিনাজপুর মহারাজা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি দিনাজপুর রিপন কলেজ(ব্রাঞ্চ) থেকে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৭ সালে৷ ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তিনি ১৯৪৮ সালে জননিরাপত্তা আইনে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং ১৯৪৯ সালে জেলখানা থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করেন৷ ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন৷[৩] ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈঠকের সময় যে ১১ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত হন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। অন্যান্যরা ছিলেন ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ সুলতানা, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমিন, এস এ বারী এটি, সৈয়দ কামরুদ্দীন হোসেইন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর হোসেন, আনোয়ার হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এম আর আখতার মুকুল সাংবাদিকতা পেশায় যোগদান করেন৷ সাপ্তাহিক 'নও বেলাল', 'পাকিস্তান টুডে' , দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক সংবাদ ইত্যাদি পত্রিকায় তিনি কাজ করেন। ১৯৫৩ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ইত্তেফাকের জন্মলগ্ন থেকে ১৯৬০ সালের জুলাই পর্যন্ত এই পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন৷ ১৯৬১ সালের শেষের দিক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এম আর আখতার মুকুল আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইউডিআই-এর ঢাকাস্থ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন৷ একই সঙ্গে তিনি ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকায় এবং পরে দৈনিক পূর্বদেশেও চাকুরী করেন৷ এম আর আখতার মুকুল ১৯৭১ সালে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে যোগদান করে তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে তিনি বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান৷ ১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়রি তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলর হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে এম আর আখতার মুকুল দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে যোগদান করেন৷ ১৯৮৭ সালের আগস্ট মাসে তিনি সরকারি চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন৷

এই লেখকের আরো বই