চাঁদের বুড়ির বয়স যখন ষোলো (হার্ডকভার)

গাদ্দার: কৃষণ চন্দর

    কৃষণ চন্দরের আরেকটি অনবদ্য উপন্যাস ‘গাদ্দার’। দেশভাগ আর দাঙ্গার আর্তনাদ নিয়ে কৃষণ চন্দরের হাহাকার এই উপন্যাসেও প্রবল। ভূমিকাতেই লেখক বলেছেন, “এজন্যই ঘৃণার বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম। আর এজন্যই অতীতের ধ্বংসস্তূপের চিত্র আমি এমনভাবে দেখাতে চেয়েছি। আমি অতীতের জন্য অশ্রুপাত করছি না। আমি ভবিষ্যৎ ভাবনায় শঙ্কিত হচ্ছি আর আগত বিপদের সম্ভাবনা থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করে দিচ্ছি।” উপন্যাসের পটভূমি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ফলে সৃষ্ট হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। এই দাঙ্গা চলাকালে লেখক মানুষের হিংস্র ও মানবিক- দুই রকমের সত্ত্বার সাথেই আমাদের পরিচয় করিয়েছেন। বুঝিয়েছেন, হিংসার বা ঘৃণার চেয়ে প্রেমই বড়ো। ঘৃণা-বিদ্বেষ মানুষকে, মানব সভ্যতাকে শুধু ধ্বংসই করতে পারে। যুগ যুগ ধরে মানুষের সমস্ত সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে বিদ্বেষ। উপন্যাসের নায়ক বৈজনাথ, বার বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। হিন্দু হয়েও বার বার মুসলমানদের বিদ্বেষ থেকে তাকে বাঁচিয়েছে অন্য কোনো মুসলমান। বৈজনাথ যখন ভারতের লালগাঁওয়ে মামার বাড়িতে, তখন তার মুসলিম প্রেমিকা শাঁদা জীবন বাঁচিয়েছিলো। ছোটবেলায় কিছু বোঝার আগেই পরিবার থেকে বৈজনাথকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শাঁদার সাথে বৈজনাথের প্রেমের পরিণতি কী, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও দুজনের প্রেম ছিলো খাঁটি। লাওগাঁওয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয়ে গেলে শাঁদার ভাই তোফায়েল, বন্ধুকে বিয়ে করার শর্তে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বৈজনাথকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলো। জীবনের বিনিময়ে নিজের প্রেমকে বিসর্জন দিয়েছিলো শাঁদা, তবু থমকে দাঁড়ায়নি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মুসলমান বন্ধু মিয়াঁর বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল বৈজনাথ। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে বিষাক্ত মনের বন্ধু হাজী, সে মিয়াঁর দুই ছেলেমেয়েকে অপহরণ করে। শর্ত- হিন্দু বৈজনাথকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। বৈজনাথকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার পর বৈজনাথ জানতে পারে, তার জীবন বাঁচানোর দায়ে বন্ধু মিয়াঁর সন্তানদের জীবন হয়তো থাকবে না। বৈজনাথ বাঁচতে চায় না, নিয়ে যেতে বলে ওই সন্ত্রাসীদের কাছে। কিন্তু মিয়াঁ চোখে জল ফেলতে ফেলতে বৈজনাথকে ফেলে চলে যায়। সন্তান হারানোর শোকে পিতার হাহাকার পাঠকের বুকেও বাজবে, বাজবে বৈজনাথ আর মিয়াঁর কান্নার শব্দ! লাহোরের সৌরদাসপুর জেলার কোটলিসুদকার গ্রামে বৈজনাথের বাড়ি। বৈজনাথের ঠাকুর্দা জমিদার। তার বাড়ির কাজের লোকেরা মুসলমান। শত নিপীড়নেও এই মুসলমানেরা তাদের জমিদারকে মেনে চলেছে। ঠাকুর্দাকে তাই বিশ্বাস করানো যায়নি যে দাঙ্গা লাগলে কী ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে। সত্যিই একদিন অবস্থা বিরূপ হলো। ঠাকুর্দার চাকরেরা তাকে চলে যাবার পরামর্শ দিলো, কারণ ওই নিরীহ মুসলমান চাকরদের ক্রীনড়কের মতো ব্যবহার করা হবে আর তখন তাদের কোনো উপায় থাকবে না। শোনেনি ঠাকুর্দা। পরিণতি হলো ভয়াবহ। রাতের আধারে পুড়ে গেল সব। লেখক পালিয়ে গেল। ফিরে এসে সে ঠাকুর্দার লাশ দেখেছিলো। আর পেয়েছিলো ঠাকুর্দার পোষা সন্তানসম্ভবা কুকুর রুমিকে। এই রুমি চরিত্রটা লেখকের আরেকটি অসাধারণ সৃষ্টি। রুমি চরিত্রটা দিয়ে লেখক মানুষের অকৃতজ্ঞতা, অমানবিকতা, অসভ্যতার চিত্র পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। বৈজনাথের পিছু নেওয়া রুমির ওপর বিরক্ত হয়ে বৈজনাথের অসংখ্য কথা যেন মানব সভ্যতার অসাড়তাকেই সামনে এনেছে। এক জায়গায় বৈজনাথ রুমিকে বলছে, “তুই কোথায় চলেছিস? তোর পেটে বাচ্চা, মা হতে চলেছিস, তুই ওখানেই থাক। তোর কোনও ভয় নেই রে। তুই ত আর মানুষ নোস, তোকে কেউ মেরে ফেলবে না। এই যে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, বর্ণে বর্নে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হানাহানি- এসব হচ্ছে উন্নত সভ্যতার উপকরণ। যে তলোয়ার দিয়ে মানুষের গলা কাটা হচ্ছে তা এই সভ্যতা রক্ষারই হাতিয়ার। এই তলোয়ার দিয়ে যে তোর গলা কাটা হবে না তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দে। তুই যে মানুষ হয়ে জন্মাসনি তার জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তুই যে ধর্ম কী তার মানে জানিস না, তোকে যে মন্দির, গির্জা বা মসজিদে যেতে হয় না তার জন্যেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। তোকে পূজাপার্বণ পালন করতে হয় না, পাঁচ অক্ত নামাজ পড়তে হয় না। রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতাও তোকে শুনতে হয় না। তোর অনেক সুবিধে কারণ তুই মানুষ নোস, একটা কুকুরমাত্র। ফিরে যা তুই, আমার পিছনে পিছনে আসিস না। আমি যে মানুষ তাই তো আমাকে পালাতে হচ্ছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে মানুষ হয়েও মানুষের কাছ থেকেই আমাকে পালাতে হচ্ছে।” রুমি শেষ অবধি তার মালিককে ছাড়তে পারেনি। মালিকের পিছু নিতে গিয়ে নদীতে ডুবে মারা গিয়েছিল। দাঙ্গার ভয়াবহতা একটা কুকুরকেও ছাড়েনি। বৈজনাথের আর্তনাদ- “এখনও যে পৃথিবীতে ভালোবাসা আছে, প্রেম যে শক্তিমান, সবরকম ক্ষুদ্রতা নীচতার ঊর্ধ্বে, মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার জন্যেই কি তুই এভাবে জীবন বিসর্জন দিলি?” রুমির অকাল মৃত্যু সংবেদনশীল পাঠককে প্রবলভাবে নাড়া দেবেই। বার বার বৈজনাথ দেখেছে, নিপীড়িত মানুষেরা বাঁচার তাগিদে সমস্ত বিদ্বেষ ভুলে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। জীবন বাঁচানোর তাগিদ যে মানুষের সমস্ত বিভেদের ঊর্ধ্বে, ঔপন্যাসিক তার একটা নমুনা দিয়েছেন। বছরের পর বছর যারা একজন আরেকজনের সাথে লড়াই করেছে, একজন আরেকজনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে, সম্পত্তি দখল করেছে, ঘৃণায় আরেকজনের ছায়া মাড়ায়নি- তারা সবাই আজ এক হয়ে পালাচ্ছে জীবন বাঁচাতে। যেমনটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচতে বনের সব জানোয়ার খাদ্য-খাদক সম্পর্ক ভুলে এক হয়ে পালাতে চেষ্টা করে। আবার এই দাঙ্গা থেকে কতো অমানুষই যে ফায়দা লুটেছে, তারও নমুনা পাওয়া যায় উপন্যাসে। কখনো স্ব-ধর্মের লোকেদের মৃতদেহ থেকে টাকা-পয়সা লুট করছে কেউ, কখনো অর্থের জন্য একইসঙ্গে নিজের ধর্মের ও ভিন্নধর্মের মানুষকে মারছে কেউ- মানুষের জীবন যেন ব্যবসার ক্ষেত্র। মনুষ্যত্বহীনতার আরও অনেক দিক দেখিয়েছেন লেখক। দাঙ্গার উন্মাদনা আর মৃত্যুভয় মানুষকে মনুষ্যত্বহীন করছে। শক্তসমর্থ সন্তান ফেলে যাচ্ছে বৃদ্ধ পিতাকে, প্রতিশোধপরায়ণ স্বামী-পিতা মেরে ফেলছে পিছুটান হওয়া স্ত্রী-সন্তানদের, তুলে আনা নারীদের ধর্ষণ করার লাইনে দাঁড়ানো ভাইকে দেখে বোন চিৎকার করে বলছে- ‘ওরে শয়তান! ওরে ওরে, আমি তোর বোন!’, দাঙ্গার পর মাটিতে পড়ে থাকা একটা কাটা হাত যেন কাঁটা হয়ে বিঁধছে পৃথিবীর গলায়! নিহত আর নিধনকারী- উভয়ের মুখে ঈশ্বরের নাম যেন ঈশ্বরের অসাড়তারই জানান দিচ্ছে। লেখক বলছেন- “নিহত আর নিধনকারীদের ওপর ঊর্ধ্বলোকে সত্যিই যদি কোনও ঈশ্বর থেকে থাকেন তবে আমি বলতে বাধ্য যে তিনি বড়ই কৌশলপ্রিয় অত্যাচারী ঈশ্বর।” ছেলের মৃত্যু, বোনের ধর্ষণের জ্বালা এক নিমেষেই বৈজনাথের মতো অসাম্প্রদায়িক মানুষকে সাম্প্রদায়িক অমানুষ করে তোলে। হয়তো কিছু মানুষ বিবেকের তাড়নায়, মনুষ্যত্বের জোরে ফিরে আসতে পারছে বৈজনাথের মতো। আর বাকিরা সাম্প্রদায়িকতার বিষ বুনতে থাকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। তবু পার্বতীর মতো প্রেমিকারা প্রেমের মশাল জ্বালছে। প্রিয়তম ইমতিয়াজের শোক বুকে নিয়ে নিজের দেশ ছেড়ে মৃত প্রেমিকের দেশে বিধবাবেশে থাকতে মরণভয় বাজি রেখে পথ চলছে। তবু নিজের দেশ পাকিস্তানে ফিরতে গিয়ে বৈজনাথ মৃতদের স্তূপের পাশে পড়ে থাকা মুসলিম কোনো শিশুকে বুকে তুলে নিয়ে নিজের ছেলে হারানোর শোক ভুলেছে। হয়তো এই দেশপ্রেমের জন্য, এই ভালোবাসার জন্য তাকে ‘গাদ্দার’ (বিশ্বাসঘাতক) বলা হবে, তবুও এই প্রেমই কি মহান নয়?
Cash On Delivery
7 Days Happy Return
Delivery Charge Tk. 50(Online Order)
উর্দু সাহিত্যের অমর কথা শিল্পী কৃষণ চন্দর। উর্দু গল্পকে এক নতুন দিক দেখাতে কৃষণ চন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অবদান কৃষণ চন্দর। জন্ম ২৩ নভেম্বর ১৯১৪, পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা জেলায়।লাহোর থেকে এমএ ও এলএলবি ডিগ্রি লাভ।
১৯৩৮ সালে কলকাতায় প্রগতিশীল লেখক সংঘের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, কৃষণ চন্দর তাতে অংশ নেন। তাঁকে সেই সম্মেলনে প্রগতিশীল লেখক সংঘ পাঞ্জাব শাখার সম্পাদক মনােনীত করা হয়। শিক্ষকতা করার সময় তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ সময় তিনি ভগত সিং এর দলে যােগ দেন। এ জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং দু’মাস জেল খাটেন। কৃষণ চন্দর তার ৬৩ বছরের জীবনের ৪০ বছর উর্দু সাহিত্যের উন্নয়নে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি অবিচ্ছিন্নভাবে লিখেছেন গল্প, উপন্যাস নাটক, চিত্ৰকাহিনী, চিত্রনাট্য ও শিশু সাহিত্য। লিখেছেন পাঁচ হাজারের অধিক উর্দু ছােট গল্প । এ ছাড়া লিখেছেন ৮টি উপন্যাস। বিভিন্ন বিষয়ে ত্রিশটি গ্রন্থ এবং তিনটি রিপাের্টাজ। কৃষণ চন্দর ছিলেন খুবই উদার দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। তিনি ধর্মীয় রাজনৈতিক বা সামাজিক সমস্ত সংকীর্ণ দৃষ্টি থেকে মুক্ত ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় গােড়ামীর তিনি সারাজীবন বিরােধিতা করেছেন। তাঁর শিকস্ত উদুর্ উপন্যাস সাহিত্যের মূল ভিত্তি বলে স্বীকৃত। বহু ভাষায় তাঁর বই অনূদিত হয়েছে। পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত। ১৯৭৭ সালের ৮ মার্চ মুম্বাইয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

এই লেখকের আরো বই