চাঁদের বুড়ির বয়স যখন ষোলো (হার্ডকভার)

দি রেপ অব নানকিং

    ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখে জাপানের ইম্পেরিয়াল আর্মি দখল করে নেয় নানকিং। নানকিং তখন চিনের রাজধানী। প্রায় লাখ খানেক সৈন্য এবং প্রচুর পরিমাণে গোলা-বারুদ থাকার পরে মাত্র পঞ্চাশ হাজার জাপানি সৈন্যের কাছে বিনা বাধায় পতন ঘটে যায় নানকিং এর। চিনা সৈন্যরা বাঁচার তাগিদে সামরিক পোশাক পরিত্যাগ করে কিংবা সাধারণ মানুষজনের পোশাক হাইজ্যাক বাঁচার চেষ্টা করে। তাদের ধারণা ছিলো জাপানি সৈন্যরা সাধারণ মানুষদের কোনো ক্ষতি করবে না। এতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। ভয়ংকর আক্রোশ নিয়ে সাধারণ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো জাপানি সৈন্যরা। মাত্র তিন সপ্তাহে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষকে হত্যা করে জাপানিরা। মাত্র পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের পক্ষে এতো কম সময়ে এতো বেশি পরিমাণ মানুষকে হত্যা করাটা একটু কষ্টকরই। কিন্তু, অভিনব সব বুদ্ধি বের করে জাপানিরা এই কাজটা করেছিলো। শুধু যে হত্যা করেছিলো, তা নয়, এতো নির্মমভাবে তারা সেই কাজটা করেছিলো যা শুনলে গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাওয়ার কথা। হাজার হাজার তরুণকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো শহরের বাইরে। সেখানে জড়ো করে মেশিনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হতো তাদের উপর, কারো কারো উপরে বেয়নেটের অনুশীলন করতো তারা, কোনো দলের উপর গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হতো। আবার কোনো দলকে কাপড়-চোপড় খুলে নামিয়ে দেওয়া হতো হিম শীতল পুকুরে কিংবা নদীতে। ঠাণ্ডায় জমে মারা যেতো তারা। কাউকে অর্ধেক পুতে ফেলা হতো মাটিতে। তারপর লেলিয়ে দেওয়া হতো জার্মান শেফার্ড কুকুরকে। এই হত্যাকাণ্ডের বাইরে জাপানিরা আরেকটা ভয়ংকর কাজ করেছিলো। সেটা হচ্ছে ধর্ষণ। ভয়ংকর ধরনের ধর্ষণ। এই ধর্ষণ থেকে রক্ষা পায়নি কচি শিশু থেকে বৃদ্ধা নারী পর্যন্ত। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, কিংবা নান, কেউ-ই রেহাই পায়নি সেই ধর্ষণের হাত থেকে। সুজান ব্রাউনমিলার তাঁর ‘এগেইনস্ট আওয়ার উইলঃ মেন, উইমেন এন্ড রেইপ’ বইতে নানকিং এর ধর্ষণকে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে ধর্ষণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছেন। প্রথম অবস্থানটা আমাদের। আমাদের নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা বাঙালি নারীদের যে ধর্ষণ, সেটাকে ছাড়িয়ে যাবার সক্ষমতা কারো নেই। নানকিং এর হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণ নিয়ে সেরা কাজটা যিনি করেছেন, তিনি হচ্ছেন আইরিস চ্যাং। ‘রেইপ অব নানকিং’ নামে একটা বই লিখেছেন। সেই বইতে নানকিং এ জাপানি সৈন্যদের বর্বরতা, পাশবিকতাকে তুলে ধরেছেন তিনি। যে হিংস্রতা, শঠতা এবং ক্রূরতা দিয়ে জাপানি সৈন্যরা সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে, লুটপাট করেছে, তার কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। জাপানিদের করা এই ক্ষত চিনের মানুষ কোনোদিন ভুলতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। একাত্তর সালে সংঘটিত ধর্ষণের ক্ষেত্রে যেমন আমরা এর সঠিক সংখ্যাটা নিরূপণ করতে পারি না, নানকিং এর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিরাজমান। বিশ হাজার থেকে আশি হাজারের মধ্যে এই সংখ্যাটা হবে বলে গবেষকরা অনুমান করেন। ধর্ষণের পরে ধর্ষিতাকে সমাজ ভালো চোখে দেখে না বলে, ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীরা সাধারণত এগুলোকে চেপে যাবার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ এবং চিনের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরো প্রকট। পাকিস্তানি সৈন্যের ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে এটা আমাদের সমাজে ভয়ানক ঘৃণার ব্যাপার, চিনের একই সমস্যা। চাইনিজ কোনো নারীর পক্ষে স্বীকার করা সম্ভব নয় যে তার গর্ভের সন্তানের পিতা একজন জাপানি সৈন্য। ঘৃণাটা এমনই তীব্র যে, ওই নারীর পক্ষে সমাজে টিকে থাকাটাই সমস্যা। ফলে, অসংখ্য নারী গর্ভপাত করিয়েছে, সন্তান জন্মের পরে সেই সন্তানকে আঁতুড়েই হত্যা করেছে। কাউকে গলা টিপে, কাউকে বা পানিতে ডুবিয়ে। একজন আমেরিকান সোশিওলজিস্ট ওই সময়ে নানকিং এ ছিলেন। তাঁর লেখা থেকে এই ঘটনা জানা যায়। শুধু যে বাচ্চাদেরই হত্যা করা হয়েছে তা নয়, জাপানিদের দ্বারা ধর্ষিত হবার লজ্জায় এবং ঘৃণায় অসংখ্য চাইনিজ নারী আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছে। একজন জার্মান কূটনীতিক জানান ১৯৩৭ সাল থেকে ৩৮ সালের মধ্যে অসংখ্য চিনা নারী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। এর বাইরে এই যুদ্ধকালীন সময়ে আরেকটা সমস্যাও ছিলো। ধর্ষণের পরে বহু নারীকে সৈন্যরা হত্যা করে ফেলেছে। ফলে, ধর্ষিতার সঠিক সংখ্যা জানাটা সহজ কাজ নয়। এর ভয়াবহতার মাত্রা দেখেই বাকিটা অনুমান করে নিতে হয় আমাদের। আগেই বলেছি, জাপানি সৈন্যদের ধর্ষণের হাত থেকে কোনো ধরনের নারীই রেহাই পায়নি। গ্রাম্য নারী, ছাত্রী, শিক্ষিকা, চাকুরীজীবী, শ্রমিক, ওয়াইএমসিএ-তে কাজ করা নারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং বৌদ্ধ নানরাও শিকার হয়েছে ধর্ষণের। এদের বেশিরভাগই শিকার হয়েছে গণ ধর্ষণের। কেউ কেউ মারাও গেছে ধর্ষণের ধকল সহ্য করতে না পেরে। কাউকে বা সৈন্যরাই মেরে ফেলে ধর্ষণের পরে পৈশাচিক উল্লাসে। নানকিং এর ঘরে ঘরে হামলা চালিয়ে ছিলো সৈন্যরা। দাবি ছিলো দুটো। টাকা আর মেয়েমানুষ দিতে হবে। নানকিং এর ছোট্ট একটা জায়গাকে আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ানরা ইন্টারন্যাশনাল সেফটি জোন হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিলো। চাইনিজ নারীদের জন্য তখন দ্বিমুখী সমস্যা। ঘরে বসে থেকে জাপানি সৈন্যদের খপ্পরে পড়বে, নাকি ইন্টারন্যাশনাল সেফটি জোনে গিয়ে হাজির হবে। কিন্তু, সেখানে যেতে গেলে ঘর থেকে বের হতে হবে। আর বের হলেই জাপানি সৈন্যদের কবলে গিয়ে পড়বে তারা। এদেরকে ঘর থেকে বের করার জন্য জাপানিরাও অভিনব বুদ্ধি নিয়ে এলো। তারা ঘোষণা দিলো, নির্দিষ্ট একটা জায়গায় গেলে চাইনিজ নারীরা হাস-মুরগি হস্তান্তর করে চাল-ডাল কিনতে পারবে। মেয়েরা সেখানে গিয়ে দেখলো, সেটা আসলে ফাঁদ। সৈন্যরা দল বেঁধে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েদের ধরার অপেক্ষায়। আশি বছরের বৃদ্ধা থেকে আট বছরের শিশু, কেউ রেহাই পায়নি এদের হাত থেকে। অসংখ্য মেয়ে শিশু ধর্ষণের সময়ই মারা গেছে। অনেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে হাটার মতো অবস্থাতেও থাকেনি। কারো কারো যৌনাঙ্গ বেয়নেট দিয়ে কেটে বড় করেছে সৈন্যরা ধর্ষণ করার সুবিধার্থে। গর্ভবতী নারীরাও রেহাই পায়নি। সন্তান জন্ম দিতে যাওয়া নারীকেও ধর্ষণ করেছে তারা। কোনো কোনো গর্ভবতী নারীকে ধর্ষণের পরে তার পেট চিরে ভ্রূণ বের করেছে সৈন্যরা পাশবিক উল্লাসে। এদের বিকৃতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিলো যে কোনো কোনো বাড়িতে গিয়ে এরা অস্ত্রের মুখে বাবাকে বাধ্য করেছে নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করতে, ছেলেকে বাধ্য করেছে মা-কে ধর্ষণ করতে। পরিবারের বাকিদের সেই দৃশ্য দেখতে হয়েছে অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে। এই ধর্ষণ প্রক্রিয়ায় অসংখ্য বাচ্চাও বলি হয়েছে। নারীদের ধর্ষণ করতে গেলে তাদের সাথে বাচ্চাও থাকে। সেই বাচ্চাদের ঝামেলা মনে করে মেরেছে তারা। কখনো কখনো ধর্ষণের সময় বাচ্চারা যাতে এই দৃশ্য দেখে কান্নাকাটি না করতে পারে, সেজন্য তাদের মুখে কাপড় গুঁজে দিতো তারা। এতে করে শ্বাসরুদ্ধ হয়েও অনেক বাচ্চা মারা গেছে মায়ের ধর্ষিতা হবার সময়ে। অসংখ্য পুরুষও নিহত হয়েছে তাদের ভালবাসার নারীকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে। ধর্ষণ করতে গিয়ে পুরো পরিবারকে হত্যা করেছে জাপানি সৈন্যরা, এমন নজিরও রয়েছে অসংখ্য। একটা ঘটনার উল্লেখ করি এখানে। ডিসেম্বরের তেরো তারিখে প্রায় তিরিশ জন সৈন্য গিয়ে হাজির হয় এক বাড়িতে। বাড়ির মালিক দরজা খুলতেই তাকে গুলি করে হত্যা করে তারা। বাড়ির যে ভাড়াটিয়া মহিলা ছিলেন, তিনি হাঁটু গেড়ে বসে সবার প্রাণ ভিক্ষা চান। বাড়িওয়ালার স্ত্রী জানতে চেয়েছিলো কেনো তার স্বামীকে হত্যা করা হলো। এর উত্তরে তাকেও গুলি করে হত্যা করে তারা। এই হট্টগোলে ভাড়াটিয়া মহিলা তাঁর এক বছরের বাচ্চাকে নিয়ে টেবিলের নীচে লুকিয়ে ছিলেন। টেবিলের নীচ থেকে তাঁকে টেনে নিয়ে আসা হয়। ধর্ষণ করা হয়, ধর্ষণের পর বুকে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হয়। তারপর যৌনাঙ্গে পারফিউমের বোতল ঢুকিয়ে দেয় তারা। মহিলার এক বছরের বাচ্চাকেও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তারা। পাশের রুমে তারা ভাড়াটিয়া মহিলার বাবা-মা আর তাঁর ষোল এবং চৌদ্দ বছরের দুই টিন এজার মেয়েকে খুঁজে পায়। নানি তার দুই নাতনিকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়েছিলেন। সৈন্যরা রিভলভারের গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর স্বামী স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে গুলি খান। এই দুই মেয়ে গণ ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পরে এদেরও হত্যা করা হয়। তারপর মেয়েদের যৌনাঙ্গে বাঁশ ঢুকিয়ে দেয় তারা। এদের আট বছরের আরেক বোন ছিলো। তাকেও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে তারা। সৈন্যরা বাড়ি থেকে বের হবার আগে বাড়িওয়ালার ছোট ছোট দুটো বাচ্চাকেও হত্যা করে যায়। জাপানি সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নানা জায়গায় পালিয়ে থেকেছে মেয়েরা। কেউ মাসের পর মাস গরু ছাগলের খোঁয়াড়ে লুকিয়ে থেকেছে, কেউ ড্রেনের মধ্যে, কেউ বা মাটি খুঁড়ে গর্ত করে তার মধ্যে পালিয়ে থেকেছে। জাপানি সৈন্যরা মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করে করে এদের লুকোনোর জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতো। মেয়েদের কেউ কেউ বৃদ্ধা সেজে থাকতো, কেউ কেউ ভয়ংকর কোনো রোগ হয়েছে এমন ভান করতো, কেউ বা চুল কেটে পুরুষ সেজে থাকতো। এগুলো খুবই সামান্য বর্ণনা। আইরিস চ্যাং এর বইতে এই সব পাশবিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বইটা পড়াটা খুবই কষ্টকর। হরর ফিল্ম দেখার যে অভিজ্ঞতা, সেই একই অভিজ্ঞতা হতে থাকে বইটা পড়ার সময়ে। বিশ্বাস হতে চায় না, একজন মানুষ কীভাবে আরেকজন মানুষের উপর এমন অত্যাচার করতে পারে, নির্দ্বিধায় খুন করতে পারে, ধর্ষণ করতে পারে, এমন সব বিকৃত কাজ-কারবার করতে পারে। কিন্তু, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা জানি, এগুলো আসলেই বিশ্বাসযোগ্য। কারণ, ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে আমাদের এই ভূখণ্ডেও। পৃথিবীতে মানুষ যেমন আছে, মানুষের রূপ ধরা পশুও তেমনি আছে। পশুগুলো যখন সুযোগ পায়, তখন তারা এই কাজগুলোই করে। অতীতে করেছে, বর্তমানে করছে, আগামীতেও করবে।
Cash On Delivery
7 Days Happy Return
Delivery Charge Tk. 50(Online Order)
t

এই লেখকের আরো বই