বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিক কলকাতার প্রেসক্লাব
মাহামুদুল হক:
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯৬৭-৬৯) সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সদ্য-উত্তীর্ণ, কৃতি, সাহসী, উদ্যমী তরুণ দুই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুরজিৎ ঘোষাল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে সরাসরি খবর সংগ্রহের তাগিদে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধরত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকেন। এরপর তাঁদের আর খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হয়, তাঁরাও শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। শুধু এই দু’জন নয়, মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার অনেক সাংবাদিক। কলকাতার লেখক-সাংবাদিক তথা সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে।
কলকাতা প্রেসক্লাবও বাদ যায়নি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায়। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নিরব সাক্ষী কলকাতা প্রেসক্লাব। এর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম অন্যতম। অসিযুদ্ধের সাথে মসিযুদ্ধও চলতো সমানতালে, কলকাতা প্রেসক্লাবে ও কলকাতার গণমাধ্যমে। তবে বেশিরভাগ কলমযুদ্ধ কলকাতা থেকেই হতো। কারণ যুদ্ধরত বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের কালি-কলম নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে কলকাতার সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ করেছেন রণাঙ্গন থেকে, কলকাতা প্রেসক্লাবে বসে মুক্তিযুদ্ধের খবর লিখেছেন, বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। প্রকৃত কলমযুদ্ধ হয়েছে কলকাতা থেকে। প্রতিবেশী আলাদা একটি দেশ ভারতে যেভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলমযুদ্ধ চলেছে, তা বিশ্বের অন্য কোন যুদ্ধের ইতিহাসে দেখা যায়নি। বিবিসি, আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর আর ভারতের ছোট-বড়-মেজো-সেজো সব সংবাদপত্র যুদ্ধের খবর প্রচারে ব্যতিব্যস্ত থেকেছে।
সেসময় বাংলাদেশের খবরই প্রধান খবর ভারতে। কলকাতার সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সব খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। রণাঙ্গনের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে সবকিছুর দ্রষ্টা হয়ে রিপোর্টাররা লিখেছেন। কলকাতার রিপোর্টাররা সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কলমযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ভোলেনি ওইসব কলমযোদ্ধাদের, মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে সম্মাননা দিয়েছে। কলকাতার সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধের ওইসব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধের নির্মমতা ও হত্যাজ্ঞের অজানা সব কাহিনি বর্ণিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিক কলকাতা প্রেসক্লাব’ শীর্ষক গ্রন্থ সংকলনে।
প্রথমেই গ্রন্থটিতে ভারতীয় ওই দুই নির্ভীক শহীদ সাংবাদিককে উৎসর্গ করে তাঁদের অবদানের স্বীকারোক্তির চিহ্ন এঁকেছেন গ্রন্থসত্ত্বাধিকারি। গ্রন্থের প্রায় অর্ধশত পৃষ্ঠায় ওই সময়ে কলকাতার গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিকদের বাংলাদেশের চলমান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলাম/মতামত স্থান পেয়েছে। সেসব তথ্যবহুল লেখা পত্রিকার পাতা থেকে তুলে আনা হয়েছে এই গ্রন্থে। এসব লেখা কলকাতার সংবাদমাধ্যম কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের মর্মস্পর্শী ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল বসুর মতো প্রথিতযশা লেখক-সাংবাদিকগণ মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে লেখনির মাধ্যমে সংহতি জানিয়েছিলেন। এছাড়া ৪৭ জন প্রথিতযশা সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে খবর সংগ্রহ করেছেন, খবর ব্যবস্থাপনা করেছেন, কীভাবে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি অভিজ্ঞতা-সাক্ষ্য বর্ণনাসহ তাদের প্রবন্ধে অজানা আরেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। ৩৬৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি একটি প্রবন্ধ শুধু ইংরেজিতে লেখা। বাকি সবই সাবলীল বাংলায় পশ্চিম বাংলার ভাষারীতিতে রচিত।
‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিক ও কলকাতা প্রেসক্লাব’ গ্রন্থটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর। ২০১৯ সালে কলকাতা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বর্ষ উপলক্ষে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ করে কলকাতা প্রেসক্লাব। ২০২০ সালে গ্রন্থটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এবছর গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। নিপুণভাবে শব্দসজ্জা-পৃষ্ঠাসজ্জাসহ পুনর্মুদ্রণে গ্রন্থের অবয়বে মুকুট পরিয়েছে ঢাকার ফ্রেন্ডশিপ প্রিন্টার্স। ঢাকা প্রকাশনার দ্বিতীয় সংস্করণে গ্রন্থটির দাম ধরা হয়েছে ৮৫০ টাকা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ছিল বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল। আর কলকাতা মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী দপ্তর ও লাখ লাখ বাংলাদেশের শরণার্থীর আশ্রয়স্থল। এসব কারণেই ১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই কলকাতা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশ্বের প্রথম শ্রেণির নিউজ এজেন্সি থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা প্রায়ই কলকাতায় যেতেন বাংলাদেশের খবর সংগ্রহের জন্য। ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ, টাইমস, গার্ডিয়ানও বাদ যায়নি। সংবাদমাধ্যম, শরণার্থী, ত্রাণপ্রতিষ্ঠান, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, আমলা-মন্ত্রী গোয়েন্দাসহ সবাই কলকাতায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকান সিনেটর, জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে আগা খান পর্যন্ত যুদ্ধের অবস্থা জানতে কলকাতায় এসেছেন। বাংলাদেশের যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা প্রেসক্লাবে কমপক্ষে চারবার এসেছেন এবং দু’বার সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ কভার করার জন্য কলকাতার গ্রান্ড হোটেল হয়ে ওঠে বিদেশি সাংবাদিকদের আস্তানা। বাংলাদেশের যুদ্ধ কলকাতা প্রেসক্লাবকে সুধারসে ভরিয়ে তোলে। কেউ আসে খবর সংগ্রহ করতে, কেউ খবর হতে। কলকাতার সংবাদমাধ্যমের সংবাদ ও ছবি বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। বিশ্ববাসী জানতে পারে মুক্তিকামী জনগণের ওপর পাকিস্তানি আর্মির পৈশাচিক বর্বরতা। এভাবেই বিভিন্ন তীর্যক লেখার মাধ্যমে তৎকালীন কলকাতার সাংবাদিকরা অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন এই গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই আমেরিকা ও পাকিস্তান সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের বিদেশমন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, তাঁর সচিব মহাবুবুল আলম চাষী, সাংবাদিক তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও চার-পাঁচজন মিলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে তাঁরা ভাষণ দেবেন এই বলে যে তারা স্বাধীনতা চান না, পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চান। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রস্তুতকৃত ভাষণের ওই খসড়াটি ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে আসে। নিউইয়র্কের যাত্রার জন্য বিমানে ওঠার আগেই ভারতীয় গোয়েন্দারা ধরে ফেলেন তাদের। গোয়েন্দাদের ইঙ্গিতে সাংবাদিকরা বিমানবন্দরে যান। দেখেন কীভাবে ওই ষড়যন্ত্রের যাত্রা ভণ্ডুল করে দিলো ভারতীয় গোয়েন্দারা।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বর্তমান চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে আমেরিকান সাংবাদিকের এক বাকযুদ্ধ হয়। কারণ ওই আমেরিকান সাংবাদিক ভারতীয় সাংবাদিকের কাছে জানতে চান, ‘ইজ ইট ইস্ট পকিস্তান?’ ভারতের পিটিআইয়ের রিপোর্টাররা উত্তরে বলেছিলেন, ‘নো, দিস ইজ বাংলাদেশ।’ ইতিহাসের এমন চরম সত্য ঘটনা সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখনিতে উঠে এসেছে, স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। তাই গ্রন্থখানি ইতিহাসের আরেকটি আকর গ্রন্থ বলা যায় নির্দ্বিধায়।
গ্রন্থের বাংলাদেশ সংস্করণের প্রকাশক জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কত বড়, কত বিস্তৃত ছিল তার আরেকটি উদাহারণ মিলে এ গ্রন্থে; যেখানে ভারতের সব বিখ্যাত সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছে। কারণ ভিন্ন দেশের সংবাদিকদের ভাষ্য বিশ্ববাসীর কাছে আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে বর্তমান প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, সিক্রেটস ডকুমেন্টসের মতো আকর গ্রন্থগুলো অবশ্যই পড়তে হবে। এছাড়া সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধকে জানার জন্য আবশ্যকীয় পাঠ্য এ গ্রন্থও।’ মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ভারতের দুই তরুণ শহীদ সাংবাদিককে স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কলমযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর তাঁর গ্রন্থাভাষে বলেছেন, ‘একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রতিবেশী দেশের সহায়তা এবং ফলশ্রুতিতে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম, এই বিশাল কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের অভিজ্ঞতায় ভরা সংকলন গ্রন্থটি এক ঐতিহাসিক দলিল।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশত বর্ষের প্রাক্কালে গ্রন্থটি ইতিহাসের নতুন দলিল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস জানার খোরাক জোগাবে। সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, গবেষকসহ ইতিহাস পিপাসুদের গ্রন্থখানি জ্ঞানপিপাসা মেটাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
সাংবাদিকরা ইতিহাসের স্রষ্টা নন, ইতিহাসের দ্রষ্টা। ইতিহাসের নির্মম সত্য উৎঘাটিত হয় সাংবাদিকদের লেখনিতে। গ্রন্থখানি সাংবাদিক তথা কলমযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ লেখনিতে ভরপুর বাংলাদেশের ঐতিহাসিক তথ্যের নিরেট দলিল। অসিযুদ্ধ, মসিযুদ্ধ ও বাকযুদ্ধের ফলশ্রতিতেই এই স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ। এসবের বয়ান-বিবরণ উঠে এসেছে কলমযোদ্ধাদের লেখনিতে। তাই গ্রন্থখানি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবশ্য পাঠ্যও বটে।
লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং স্থায়ী সদস্য, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা।