চাঁদের বুড়ির বয়স যখন ষোলো (হার্ডকভার)

ওঙ্কার

    “ওঙ্কার” বইটির ফ্ল্যাপের কথাঃ আহমদ ছফা সাহিত্যচর্চা শুরু করেন উপন্যাস দিয়ে। বেশ কয়েকটা ছােটো গল্প লিখে হাত মসকো করার প্রচলিত নিয়মটি তিনি মানেননি; তাঁর প্রকাশিত প্রথম বইটিও একটি উপন্যাস। ছফার উপন্যাস আকারে ছোট হলেও কোনােটাই কিন্তু ছােটো গল্পের সম্প্রসারণ নয়, এগুলাে একেবারেই উপন্যাস। চেনাজানা জীবনের ভেতরের ব্যাপারটা নানা দিক থেকে দেখার দায়িত্ব নিয়ে সমাজ ও রাজনীতির ভাঙাচোরায় কাজ করছে কোন রহস্য, তারই অনুসন্ধানে ছফা নিয়ােজিত। সুখ ও স্বস্তি ঞ্জলি দিয়ে তিনি কাজ করেন এমন সব পরিবেশ নিয়ে যা বেশির ভাগ সময়ে তার স্বভাবের অনুকূল নয়। পাঠককে তিনি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন যাদের সঙ্গে। বেশির ভাগ সময়েই তিনি নিজে বা তার পাঠকরা। তাদের পছন্দ করেন না; অন্তত তাদের অনেক কাণ্ডকীর্তিতে সায় দেওয়া মুশকিল। সেই খুচরােখাচরা ও টুটাফাটা মানুষের একেকটা আস্ত চেহারা তৈরি। করতে ছফাকে রীতিমতাে যুদ্ধ করতে হয় এবং পাঠককে তিনি উস্কে দেন এ যুদ্ধে নেমে পড়তে । “ওঙ্কার’-এ আহমদ ছফা গপ্পো ফাঁদতে বসেননি, কাহিনীর সূত্র ধরে পাঠককে তিনি টেনে নেন এমন একটি জায়গায় যেখানে পৌছে গল্পটা ভুলে গেলেও কিছু এসে যায় না, কাহিনী গৌণ হয়ে সেখানে প্রবল। হয়ে ওঠে অনেক দিনের অনেক মানুষের গ্লানি, জড়তা ও শােষণ এবং গ্লানি থেকে মুক্তির রক্তাক্ত সংকল্প। নিরুপায় হয়ে বোবা মেয়েকে বিয়ে করে, একরাতে স্ত্রীকে হারমোনিয়ামে গান গাওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা করতে দেখে হঠাৎ করেই মমতা অনুভব করে সে স্ত্রীর প্রতি। হঠাৎ ভালবাসায় আপ্লুত স্ত্রীর কথা বলার চেষ্টা বেড়ে যায় আরো। ১৯৬৯ এর আসাদের মৃত্যুর পর বাড়ির সামন দিয়ে চলে যাওয়া মিছিলের সাথে গলা মিলাতে চাইলে তার গলায় রক্ত উঠে আসে। ****************** অতীত ঐশ্বর্য নিয়ে পড়ে থাকা এক বৃদ্ধ, নতুন বাস্তবতায় টিকে থাকার চেষ্টায় এক যুবক এবং ভাগ্যের গেরাকলে সেই যুবকের সাথে দাম্পত্যের বাঁধনে বাধা এক বোবা মেয়ে; এদেরকে নিয়েই রচিত হয়েছে আহমদ ছফার উপন্যাস ‘ওঙ্কার’। গল্পের প্রথমেই আমরা পরিচিত হই পুরোনো জৌলুসের গৌরবে অন্ধ এক বয়স্ক ব্যক্তির সাথে। অতীতকে আকড়ে ধরে রাখা এই ব্যক্তির চোখে অন্য গ্রামবাসীরা এখনো তার প্রজা এবং সে তাদের প্রভু। কিন্তু তার চাপিয়ে দেয়া দাসত্বকে আর মেনে নিচ্ছে না অন্যরা। এসব অবাধ্য প্রতিবেশীদের হেনস্তা করার জন্য তিনি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে বেড়ান। আর এই কাজে তার প্রধান সহযোগী ছিলেন আবুনসর মোক্তার। কিন্তু নিজের একসময়ের এই ভৃত্যের কাছেই মামলায় হেরে গিয়ে তিনি হয়ে যান সর্বস্বান্ত। আইয়ুব খানের সেনা সমর্থিত সরকারের এক বিশেষ অনুগত হিসেবে পরিচিত আবুনসর তার একসময়ের প্রভুকে ঋণের দায় থেকে মুক্তি ও তার পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তার বিনিময়ে একটি কাজ করতে হবে। নিজের ছেলেকে মোক্তার সাহেবের বোবা মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে হবে। অসুস্থ বাবা-মা, আর নিজের ছন্নছাড়া অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বিয়েতে রাজি হয়ে যায় ছেলেটি। বিয়ে হয়ে তাদের মধ্যে আর বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তালুকদার ও তার স্ত্রী ইহলোকের পাঠ চুকিয়ে দেন। বোবা স্ত্রী আর ছোট বোনকে নিয়ে শহরে চলে আসে ছেলেটি। বোবা মেয়েটি নিজের সর্বসত্ত্বা দিয়ে চেষ্টা করে স্বামীর মন জয় করতে। কিন্তু স্বামীর কাছে নিজের স্ত্রীর নির্বাক উপস্থিতি স্বীয় অক্ষমতা ও অসহায়ত্বকে জানান দিতে থাকে। কিন্তু ছেলেটির এই রুক্ষ মনোভাব একসময় পালটে যায়। স্ত্রী ও ছোট বোনকে নিয়ে এক ছোট্ট, সুন্দর, গোছানো সংসারে ভালোই কাটতে থাকে তাদের দিনগুলো। কিন্তু তাদের শান্তির জীবনে এবার বাগরা দেয় আইয়্যুব বিরোধী আন্দোলন। সংবাদপত্রে, অফিসে, রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে সব জায়গাতে একই ফিসফিসানি। এবার বোধ হয় পতন হতে যাচ্ছে আইয়ুব খানের। ভালো লাগে না এসব কথা ছেলেটির কাছে। ছেলেটির ভেতরের স্বাধীনতার চেতনা তখন ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থের আড়ালে ঢাকা। নিজের সুন্দর মসৃণ জীবনের জন্য মুক্তির চেয়ে তার সামরিক শাসনের ক্রীড়নক হিসেবে থাকাই শ্রেয়। কিন্তু সমাজের এত প্যাচ থেকে আলাদা বোবা মেয়েটি যাচ্ছিল স্বামীর ঠিক ভিন্ন পথে। নিজের বাসাতে জানালার গ্রিলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সে শুনতে থাকে আন্দোলনরত মানুষের শ্লোগান ‘বাংলাদেশ’। মুখ ফুটে বলতে না পারলেও এই শ্লোগানকে সে মনে ধারণ করে নেয়। মিছিলের সাথে তাল মিলিয়ে সেও বলতে চায় ‘বাংলাদেশ’। কিন্তু নিজের অক্ষমতার কাছে সে বারবার পরাস্ত হয়। কিন্তু তার চেষ্টা সে থামায় না। লেখকের চোখে সমগ্র বাংলাদেশ ছিল তখন সেই বোবা মেয়েটির মত। বছরে পর বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভকে উগড়ে দেয়ার জন্য ছটফট করছিল সে। সে জানত যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে রক্ত বিসর্জন করতে হবে, তার নিজের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে, কিন্তু না, তারপরও সে থেমে থাকে নি। স্বাধীনতার নেশায় সে এতটাই মত্ত যে তখন বাকি সবকিছু তার কাছে উহ্য। লেখক আহমদ ছফা উপন্যাসটিতে একাধিক চরিত্রের কোনো নাম দেননি। এই উপন্যাসে সব বাহুল্যকে উহ্য রেখে সেই সময়কার অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার মানসিকতাকে প্রতিকী রূপে সেইসময়ের কিছু মানুষের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আহমদ ছফার সাহিত্য জীবনের অন্যতম সেরা এই উপন্যাসটি পড়ে দেখতে পারেন। আশা করছি আপনাদের সময় বিফল যাবে না।
Cash On Delivery
7 Days Happy Return
Delivery Charge Tk. 50(Online Order)
 আহমদ ছফা:

আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)  প্রতিবাদী লেখক, প্রগতিপন্থি সাহিত্যকর্মী ও সংগঠক। ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন  চট্টগ্রাম জেলার  চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। চট্টগ্রামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া সমাপ্ত করে ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

আহমদ ছফা ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী একজন সৃষ্টিশীল লেখক। ষাটের দশকে তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা হয়। সৃষ্টিধর্মী লেখক হিসেবে তিনি গল্প,  উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ,  শিশুসাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখান। তিনি বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য-সাময়িকপত্র সম্পাদনা করেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তিনি এক সফল লেখক। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প-উপন্যাস রচনায় কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর আখ্যানমূলক রচনায় বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, মুক্তিকামনা ও স্বাধীনতাস্পৃহা এবং সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র রূপায়িত হয়েছে।

সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭), উদ্ধার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান পতন (১৯৮৯), অলাতচক্র (১৯৯০), ওঙ্কার (১৯৯৩), গাভীবৃত্তান্ত (১৯৯৪), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬) আহমদ ছফার উপন্যাস এবং নিহত নক্ষত্র (১৯৬৯) তাঁর গল্পগ্রন্থ। কবিতায়ও আহমদ ছফার স্বতন্ত্রতা রয়েছে। জল্লাদ সময়, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমোবে এবার ইত্যাদি একাধিক কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা তিনি। অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশ, লোকজ ভাষা, পুথিপুরাণের শব্দ ও বাকরীতির প্রকাশ তাঁর কবিতার ধরণ হয়ে উঠেছে। জার্মান কবি গ্যেটের বিখ্যাত কাব্য ফাউস্ট-এর অনুবাদ এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের সংশয়ী রচনার বাংলা রূপান্তর আহমদ ছফাকে অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতি এনে দিয়েছে। অবশ্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবেই তাঁর পরিচিতি সর্বাধিক। আহমদ ছফার গবেষণার বিষয় ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজ। এ সমাজের গঠন, বিকাশ, জাগরণ ও প্রতিষ্ঠা এবং বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যা নিয়ে অন্যান্য চিন্তাবিদের মতো ছফাও গভীরভারে ভেবেছিলেন। ষাটের দশক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে জাতির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন। ছফার চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য রচনা বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭৩) ও বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৭৬)-এ।

এ দুটি বিশেষ চিন্তামূলক রচনাসহ দেশ, সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক নিবন্ধাবলি ছফাকে বাংলাদেশের  বুদ্ধিজীবী লেখকের মর্যাদাপূর্ণ আসন দিয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস অনুসন্ধানে ছফার আগ্রহ সবসময় পরিলক্ষিত হয়েছে এবং সে আগ্রহ থেকে তিনি লিখেছেন সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস; কিংবা প্রাজ্ঞ ও বহুদ্রষ্টা ব্যক্তির মননে সমাজ-প্রবাহের ঘটনাপুঞ্জ যে তাৎপর্যমন্ডিত হয় তার ইতিবৃত্তান্ত যদ্যপি আমার গুরু। ছফার রাজনৈতিক প্রবন্ধ এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিষয়ে রচনাও আছে। সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে তিনি বিভিন্ন সময়ে কলাম লিখেছেন এবং শেষের দিকে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির চলমান চিত্র ও সংবাদ বিষয়ে নানা নিবন্ধ লিখে সাহসী ও বিবেকী বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেন।

আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী। প্রগতির সংঘশান্তিতে তিনি আস্থাবান ছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিল প্রচুর। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আহমদ শরীফের নেতৃত্বে  বাংলাদেশ লেখক শিবির গড়ার মুখ্য ভূমিকাও পালন করেন তিনি। মুক্ত-স্বাধীন স্বদেশভূমিতে প্রগতির তরুণ সৈনিকদের অভ্যুদয় ছফার কাঙ্ক্ষিত ছিল। এজন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজে আরও মানববাদী সংগঠন গড়ে তোলেন কিংবা প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল সংগঠকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। তাঁর মৃত্যু ২০০১ সালের ২৮ জুলাই। 

এই লেখকের আরো বই