চাঁদের বুড়ির বয়স যখন ষোলো (হার্ডকভার)

স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব

    আল কুরআনে মহান স্রস্টার পরিচিতি: স্রস্টা বলতে কেউ আছেন কি ? প্রাচীন ধর্ম বিশেষ করে ইয়াহুদি ও খৃষ্টান ধর্ম এ প্রশ্নের জবাবে ইতিবাচক কথা বলেছে। বলতে গেলে আল্লাহ’র অস্তিত্বে বিশ্বাসই এ ধর্ম দুটির প্রধান ভিত্তি। যদিও এ ধর্ম দুটি স্রস্টা সম্পর্কে খুব একটা স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ধারণা উপস্থাপিত করতে পারে নি। প্রথম পর্যায়ে নির্ভুল ধারণা উপস্থাপিত করে থাকলেও পরবর্তীতে তা চরম মাত্রায় বিভ্রান্তির বেড়াজালে সে ধারণা আচ্ছন্ন ও প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। আর জনগণ সে ধারণার দরুন দিশেহারা হয়ে গেছে। ফলে এই ধর্ম দুটির প্রতি বিশ্বাসীদের অনেকেই দর্শন ও বিজ্ঞান চিন্তার ক্ষেত্রে স্রস্টার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হতে পারে নি। কিংবা বলা যায়, দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চায় তারা স্রস্টা বিশ্বাসের প্রতি প্রথমে উপেক্ষা ও পরে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। এ কারণে তারা যে দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রাসাদ রচনা করেছে, তা বাস্তবে সম্পূর্ণ স্রস্টা বিশ্বাসহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা স্রস্টার পরিবর্তে “জড়” বা “বস্তু” (Matter) কেই সৃষ্টির মৌল উৎস ধরে নিয়েছে এবং বর্তমান বিশ্বলোককে এই বস্তুর ক্রমবিকাশ বা বিবর্তনের ফলশ্রুতি বলে মনে করেছে। এভাবে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দর্শন ও বিজ্ঞানের যে চর্চা ও বিকাশ হয়েছে তা সম্পূর্ণ স্রস্টা বিশ্বাসহীন দর্শন ও বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এই দর্শন ও বিজ্ঞানে স্রষ্টাকে স্বীকার করা হয়নি, শুধু তা-ই নয়, স্রস্টা বিশ্বাসকে দর্শন ও বিজ্ঞান পরিপন্থী সাব্যস্ত করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। আর ধর্ম যেহেতু স্রস্টা বিশ্বাসের উপর ভিত্তিশীল, তাই ধর্মকেও তারা তারা আধুনিক দর্শন ও বিজ্ঞানের চূড়ান্তভাবে অ-গ্রহণযোগ্য বা কুসংস্কার মনে করে তার প্রতি ধিক্কার দিতেও উদ্যত হয়েছে। তারা বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে, দর্শন-বিজ্ঞান ও ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে মৌলিক বিরোধ। ধর্ম মানলে দর্শন ও বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে হয়। আর যারা দার্শনিক ও বিজ্ঞানী তারা কোনক্রমেই ধর্মকে মেনে নিতে পারে না। বরং ধর্মকে অস্বীকার, অগ্রাহ্য করাই দার্শনিকতা, বৈজ্ঞানিকতা। এ পর্যায়ে বিশ্বলোকে সৃষ্টির যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা একান্তই গোঁজামিল ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। স্রস্টা ছাড়াই কি সৃষ্টি সম্ভব ? কর্তা ব্যতিরেকে কর্ম সম্পাদিত হতে পারে ? বীজ ছাড়াই বৃক্ষ ? এই বিশ্বলোক কি স্বতঃস্ফূর্ত জড়-এর স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ বা অভিব্যক্তি ? তারপক্ষে যতো সূক্ষ্ম ও জটিল ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক, যুক্তিবাদী মন তাতে কিছুমাত্র স্বস্তি ও সান্ত্বনা পেতে পারে না। আদিতে ছিল জড়। দূর অতীতে কোন এক মুহূর্তে তাতে আপনা আপনি হঠাৎ করে গতির সৃষ্টি হয়, এক মহা বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়, আর তারই ফলশ্রুতিতে ক্রম অভিব্যক্তির ধারায় এই বিশ্বলোক অস্তিত্ব লাভ করে, সৃষ্টিলোকের এই ব্যাখ্যাই বরং নিতান্তই হাস্যকর ও বাল্যসুলভ প্রতিভাত হচ্ছে। এ কথাটিকে কোন দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ববিদ অনুমোদিত বিধি বা সমস্যা সমাধানের সাধারণ সংকেত (Formula) মনে করে নেওয়া কোন সুস্থবিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। এ কথাটিকে নেহাত আজগুবী ও অপরিপক্ক মগজের উদ্ভট চিন্তা ছাড়া আর কিছুই মনে করা যায় না। এটি একটি ধারণা মাত্র, এর পশ্চাতে কোন নির্ভুল জ্ঞানের ভিত্তি নেই। কেননা এই তত্ত্বের উপর এই কঠিন প্রশ্ন তীব্র হয়ে দেখা দেয় যে, আদিতে যে জড় ছিল, তার পূর্বে কি ছিল ? জড় কোত্থেকে কেমন করে এলো ? ….. এর জবাবে একমাত্র যে কথাটি বলা যায়, তা হলো এই আদিম জড় এর পূর্বে ছিলেন একমাত্র আল্লাহ। তখন আর কিছুই ছিল না। কিন্তু আল্লাহ কে – তার জবাব কুরআন থেকে পেশ করা হচ্ছে। মহান আল্লাহ আছেন: দুনিয়ার সেরা বিজ্ঞানীগণ নিজেদের স্বাধীন বিমুক্ত ও অনাসিক্ত অপ্রভাবিত বৈজ্ঞানিক চিন্তার ফলে বিশ্বলোকের একজন মহাপরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞানী স্রস্টার অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেছেন, কুরআন মাজিদ সেই প্রয়োজনবোধের অকাট্য যৌক্তিকতা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে স্বীকার করেছে এবং উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে যে, হ্যা, সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আছেন। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এই বিশ্বলোক কখনোই অস্তিত্ব লাভ করতে পারতো না, পারেনি এবং তিনি বহু নন, তিনি এক ও একক। তিনি নিজ কুদরতে মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ নতুনভাবে পূর্বের কোন নমুনা না দেখে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন আসমান ও যমিনের সবকিছু। আল্লাহ মহাবিশ্বকে নিজ শক্তিবলে সৃষ্টি করে নিজেকে আড়ালে রেখে তাকে কঠিন ও শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছেন। সৃষ্টির কোন কিছুর মধ্যে তিনি নেই, সৃষ্টির কোন একটি বিন্দুও তার প্রত্যক্ষ ও কঠিন নিয়ন্ত্রণ পরিচালনা থেকে সামান্য পরিমাণেও মুক্ত নয়। তার সর্বশেষ নাযিল করা কালামে তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন। ফলে তার দেওয়া পরিচিতির মাধ্যমেই আর তার ঘোষিত স্বীয় গুণবাচক নামসমূহের মাধ্যমেই তাকে জানা সম্ভব। অন্য কোনভাবে বা উপায়ে তাকে জানা ও চেনা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আল্লাহ’র নিজের সেই কালাম থেকেই তার পরিচিতি কতিপয় দিক এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, আল্লাহ’র এই পরিচিতি সামগ্রিক নয়, সম্পূর্ণও নয়। “আল্লাহ আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর কোনরূপ নমুনা না দেখেই নিজ শক্তিবলে সৃষ্টিকর্তা …… তিনিই সমস্ত ও প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন আর তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় অবহিত।” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১০১) অর্থাৎ, এই আসমান যমীনের অস্তিত্ব পূর্বে ছিল না। আল্লাহ’ই নিজ শক্তিবলে ও নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করে এসব থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি। এর প্রত্যেকটি সম্পর্কেই তিনি পুরোমাত্রায় অবহিত রয়েছেন। তার জানার আওতার বাইরে কোন জিনিস নেই। মানুষকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন – “আমরাই তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তাহলে তোমরা এই কথার সত্যতা স্বীকার করে নিচ্ছো না কেন ?” (সূরাহ আল-ওয়াকিয়াহ, ৫৬ : ৫৭) “….. আল্লাহ’ই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অন্ধকার ও আলো তিনিই বানিয়েছেন …” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১) সৃষ্টি অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে বের করে অস্তিত্বমান বানিয়ে দেওয়ার এই কাজ একমাত্র আল্লাহ’র। তিনি ছাড়া এই কাজ করার সাধ্য আর কারোই নেই। কাজেই তিনি যা সৃষ্টি করেন, তা তার সমান বা তার সাথে তুল্য কোনক্রমেই হতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেছেন – “যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি তার মতো বা তার তুল্য হতে পারেন যে সৃষ্টিকর্ম করে না ? তোমরা কি এ বিষয়ে গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করো না ?” (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ১৭) সৃষ্টিকর্ম মৌলিকভাবে এক তুলনাহীন কাজ। এই কাজ যিনি করেন, তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে, সবচেয়ে বড় ও মহান, বিবেকমান কোন মানুষই তা অস্বীকার করতে পারে না। তাই আল্লাহ’কে সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বশক্তির অধিকারী অবশ্যই মানতে হবে। “…… মহান পবিত্র সর্ব দুর্বলতা মুক্ত তিনি, তিনিই আল্লাহ – এক ও একক, মহাপরাক্রমশালী। তিনিই সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী পরম সত্যতা সহকারে, তিনিই রাতকে দিনের উপর আবর্তিত করেন, দিনকে করেন রাতের উপর; সূর্য ও চাঁদকে তিনিই সুদৃঢ়ভাবে কর্মে নিরত-নিয়ন্ত্রিত রেখেছেন, সবই একটি সুনির্দিষ্ট সময়কালের জন্য সদা প্রবাহমান ….” (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯ : ৪-৫) “আল্লাহ’ই হচ্ছেন প্রত্যেকটি জিনিসের স্রস্টা, প্রত্যেকটি জিনিসের উপর সংরক্ষক-পর্যবেক্ষক-কর্তৃত্বশীল। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর রহস্য উদঘাটনের সমস্ত কুঞ্জিকা তারই কর্তৃত্বাধীন ….” (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯ : ৬২-৬৩) “আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং এ দুটোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থানকারী সকল জীব-প্রাণীর সৃষ্টিতে আল্লাহ’র অস্তিত্বের নিদর্শন রয়েছে …” (সূরাহ আশ-শুরা, ৪২ : ২৯) অর্থাৎ, আমরা যে পৃথিবীর বুকে বসবাস করি, এ পৃথিবীর উপর চাঁদোয়া সদৃশ যে নীল আসমান, তাতে জ্বলজ্বল করা তারকারাজি, উজ্জ্বল চাঁদ, দেদীপ্যমান সূর্য এবং পৃথিবীর দিকে দিকে যে লক্ষ-কোটি জীবজন্তু বিচরণশীল – এ সবই এক মহাশক্তিমান স্রস্টার অস্তিত্বকে অপরিহার্য করে এবং তিনি চিরন্তন ও শাশ্বত সত্তা হিসেবে রয়েছেন, এ সবই তার অকাট্য প্রমাণ। “তিনি খুঁটি ব্যতীত আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করেছেন – তোমরা তা দেখছো, আর পৃথিবীতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত উঁচু পর্বতমালা করেছেন সংস্থাপিত যাতে পৃথিবী তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে, আর আমি ঊর্ধ্বলোক থেকে পানি বর্ষণ করেছি, পরে পৃথিবীতে সর্ব প্রকারের উত্তম জোড়া সৃষ্টি করেছি। এ সবই তো আল্লাহ’র সৃষ্টি, এরপর আল্লাহ ছাড়া আর কে কি সৃষ্টি করেছে তা এনে আমাকে দেখাও …..” (সূরাহ লুকমান, ৩১ : ১০-১১) অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্ম এককভাবে একমাত্র আল্লাহ’র। সৃষ্টিকর্তা তিনি ছাড়া আর কেউই নেই। তিনিই আকাশমণ্ডলকে মহাশূন্যে ভাসমান করে রেখেছেন, তাকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখার জন্য কোন দৃশ্যমান খুঁটি ব্যবহার করা হয়নি। আর পৃথিবীও মহাশূন্যে ভাসমান একটি গ্রহ। শূন্যে ভাসমান থাকার কারণে তা হেলতে দুলতে পারে। আর তাহলে ভূপৃষ্ঠে কারো পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। এ কারণে পৃথিবীর বুকে আল্লাহ দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ভারী ভারী পর্বতমালা দাঁড় করে দিয়েছেন। তিনিই পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। কেননা বৃষ্টি বর্ষিত না হলে ভূপৃষ্ঠে ফল-ফসলের সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়ে যেতো। ভূপৃষ্ঠে যে শস্য-শ্যামল সবুজ মন-ভোলানো শোভা বিরাজ করছে, তার প্রধান কারণ এই বৃষ্টি। এর ফলে সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভবপর হচ্ছে। সৃষ্টি করা আর সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় খোরাক-পোশাক ইত্যাদি জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ’র পক্ষেই সম্ভব। “(হে নবী), তুমি ওদের জিজ্ঞেস করো – আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী থেকে তোমাদেরকে কে রিযক-জীবনোপকরণ দিচ্ছে ? কিংবা শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তিরই বা মালিক কে ? কে জীবন্তকে মৃত থেকে ও মৃতকে জীবন্ত থেকে বের করে আনে ? আর কে-ই বা এসব ব্যাপারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সুসম্পন্ন করে ? …..” (সূরাহ ইউনুস, ১০ : ৩১) এ প্রশ্ন কয়টির জবাব যে একটিমাত্র শব্দ – আল্লাহ, তা কে অস্বীকার করতে পারে ? “সেই মহান সত্তাই তো সূর্যকে আলোকমণ্ডিত ও চন্দ্রকে উজ্জ্বল-উদ্ভাসিত বানিয়েছেন এবং তার জন্য মনযিলসমূহ সুনির্ধারিত পরিমিত করেছেন, যেন তোমরা বছরের সংখ্যা ও হিসাব জানতে পারো, আল্লাহ এসব পরম সত্যতা সহকারে সৃষ্টি করেছেন …..” (সূরাহ ইউনুস, ১০ : ৫) “আল্লাহ তো তিনিই, যিনি আকাশমন্ডলীয় অবয়বসমূহকে কোন দৃশ্যমান খুঁটি বা স্তম্ভ ছাড়াই ঊর্ধ্বে তুলে রেখেছেন, এরপর তিনি আরশের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছেন …..” (সূরাহ আর-রদ, ১৩ : ২) আল্লাহ এই বিশ্বলোককে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সাথে সমগ্র বিশ্বলোকের উপর এক প্রতিটি অণু-পরমাণুর উপর নিজস্ব নিরংকুশ কর্তৃত্ব সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই বিশ্বলোকের উপর অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃত্ব সার্বভৌমত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। তিনি এক একক ও লা-শরীক। “তারা কি কখনো তাদের উপরে অবস্থিত আকাশমণ্ডলের দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখেছে যে, কিভাবে আমরা তা নির্মাণ করেছি, সুসজ্জিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত বানিয়েছি এবং তাতে কোনরূপ ফাঁক ও ফাটল নেই ? আর যমীনকে আমরা সুবিস্তীর্ণ করেছি, তাতে পর্বতমালার ভার স্থাপন করেছি এবং তাতে তরতাজা চাকচিক্যময় জোড়াসমূহ উৎপাদন করেছি।” (সূরাহ ক্বাফ, ৫০ : ৬-৭) সুসজ্জিত সুবিন্যস্ত আকাশমণ্ডল মানুষের কাছে চিরদিনের জন্য এক মহাবিস্ময়ের ব্যাপার। তার নির্মাণ কৌশল ও চাকচিক্যময়তা মানুষকে সবসময়ই আকৃষ্ট করেছে। সেই সাথে প্রশস্ত বিস্তৃত পৃথিবী, তাতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতমালা মানুষকে চিরকাল মুগ্ধ ও বিমোহিত করেছে। আর এসবের সহযোগিতায় মাটিতে উত্তম উৎকৃষ্ট ফল ও ফসলের উৎপাদন মানুষকে এখানে বেঁচে থাকার উপকরণ জুগিয়েছে। যে নিয়ম আকাশমণ্ডলেও কার্যকর, ঠিক সেই নিয়ম-শৃঙ্খলা যমীনের বুকে চালু। যমীনের বুকে যেমন উঁচু উঁচু শক্ত দুর্ভেদ্য প্রস্তরময় পর্বতমালা রয়েছে, তেমনি রয়েছে নরম মসৃণ উর্বরাশক্তি সম্পন্ন ভূমি, যেখানে ফল ও ফসলের নরম লতাপাতা ও শক্ত কান্ড ও শাখা-প্রশাখা পত্র-পল্লব সুসজ্জিত গাছপালাও রয়েছে। স্পষ্ট মনে হচ্ছে, শত-কোটি আলোকবর্ষের দূরত্বে অবস্থিত আকাশমণ্ডল ও পায়ের তলায় পড়ে থাকা মাটি, মাটির প্রতিটি কণা যেন একই সূত্রে গাঁথা, এক অখণ্ড বস্তুপিন্ড। একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং প্রত্যেকটি অংশের সাথে আর অংশে নিবিড় সম্পর্ক, এ কারণে অন্যটি, একটি অপরটির সহযোগী, পরিপূরক। এর কোন একটি না হলে যেন অন্য কোন একটিও হতে পারতো না। এর কোন একটি অংশকে বাদ দিলে অপর অংশগুলো যেন নিতান্তই অর্থহীন, সম্পূর্ণ নিস্ফল। পরস্পর পরিপূরক এই অসংখ্য কোটি সৃষ্টিকুল , দূর-ঊর্ধ্বের নীলাকাশ আর নিচের এই বিস্তীর্ণ ধরণীতল সবই মানুষের প্রয়োজন পূরণে ও ব্যাপক কল্যাণ সাধনে সদা ব্যতিব্যস্ত ও কঠিনভাবে কর্মরত। ভিন্নভিন্নভাবে এর প্রত্যেকটি আর সমষ্টিগতভাবে এই গোটা সৃষ্টিলোক নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে মহাশক্তিমান দয়া ও অনুকম্পার একমাত্র আধার মহান আল্লাহ’র অস্তিত্ব তার একত্ব ও এককত্ব। তিনি না হলে এসব এবং এসবের কোন কিছুই হতে পারতো না। তিনি নিজ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত আছেন বলেই এসবের অস্তিত্ব সম্ভবপর হয়েছে। যেদিক যেখানে যা কিছু আছে, সবই আর প্রত্যেকটি কেবলমাত্র তারই অবদান, তারই তুলনাহীন দয়া অনুকম্পার ফলশ্রুতি। তাই বলা হয়েছে – “বলোঃ তিনি আল্লাহ – এক ও একক। আল্লাহ সবকিছু থেকে নিরপেক্ষ অনির্ভরশীল – সবই তার প্রতি মুখাপেক্ষী। তার কোন সন্তান নেই, আর তিনিও জাত নন। আর তার সমতুল্য সমকক্ষ কেউ কোথায়ও নেই।” (সূরাহ আল-ইখলাস, ১১২ : ১-৪) কুরআনে আরো বলে হয়েছেঃ “আল্লাহ আকাশমণ্ডল ও যমীনের নূর, (বিশ্বলোক) তার নূর হওয়ার দৃষ্টান্ত এরূপ যেমন একটি তাকের উপর প্রদীপ রক্ষিত, প্রদীপটি একটি ঝাড়ের মধ্যে, ঝাড়টির অবস্থা এরূপ – যেমন মোতির মতো ঝকমক করা তারকা, সেই প্রদীপ যায়তুনের বরকতওয়ালা বৃক্ষের তেল দিয়ে উজ্জ্বল করা হয়, যা না পূর্বের না পশ্চিমের, যার তেল স্বতঃই প্রজ্বলিত, আগুন স্পর্শ করুক আর না-ই করুক, (এভাবে) আলোর উপর আলো (বৃদ্ধি পাওয়ার সব উপাদান একত্রিত), আল্লাহ তার নূরের দিকে যাকে ইচ্ছে পথ দেখান …..” (সূরাহ আন-নূর, ২৪ : ৩৫) আল্লাহ’র আরো ব্যাপক পরিচিতি স্বরূপ বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ তো সেই চিরঞ্জীব শাশ্বত সত্তা, যিনি সমগ্র বিশ্বজগৎকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছেন, তিনি ছাড়া আর কেউই প্রভু-সার্বভৌম নয়, তন্দ্রা বা নিদ্রা কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না, আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সব তো তারই কর্তৃত্ব মালিকানাধীন, তার কাছে তার অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করতে পারে এমন কে আছে ? যা কিছু লোকদের সামনে আর যা তাদের অগোচরে, সবই তো তার জানা। মানুষ তার জ্ঞানের একবিন্দু জিনিসও কখনোই আয়ত্তাধীন করতে পারে না, তিনি নিজেই যা জানাতে চান তা ছাড়া। তার নিরংকুশ কর্তৃত্ব সার্বভৌমত্ব সমগ্র আসমান-যমীনকে আয়ত্ত করে নিয়েছে। এই আসমান ও যমীনের সংরক্ষণ তাকে বিন্দুমাত্রও ক্লান্ত করতে পারে না, তিনিই একমাত্র মহান সু-উচ্চ শ্রেষ্ঠতম।” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ২৫৫) “মহান বরকত সম্পন্ন সেই সত্তা, যার মুষ্টিতে সমগ্র কর্তৃত্ব মালিকত্ব সার্বভৌমত্ব নিবদ্ধ, আর তিনি তো সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। সেই সত্তাই মৃত্যু ও জীবন উদ্ভাবন করেছেন তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম আমলকারী কে, যেন তিনি তার পরীক্ষা করতে পারেন, আর তিনিই তো দুর্জয় ও মহাক্ষমাশীল।” (সূরাহ আল-মূলক, ৬৭ : ১-২) “আল্লাহ’ই সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী পরম সত্যতা সহকারে এবং তিনিই তোমাদেরকে আকার-আকৃতি দিয়েছেন, অতীব উত্তম বানিয়েছেন তোমাদের আকার-আকৃতি। আর শেষ পরিণতি তো তারই কাছে। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সবকিছুই আল্লাহ জানেন, যা তোমরা গোপন রাখো আর যা প্রকাশ করো, তাও তার জানা। আসলে আল্লাহ (মানুষের) অন্তরে নিহিত প্রচ্ছন্ন বিষয়েও অবহিত।” (সূরাহ আত-তাগাবুন, ৬৪ : ৩-৪) আসমান-যমীন নির্মাণ ও মানুষের বাহ্যিক আকার-আকৃতি দান ও সর্বোত্তম আকৃতি ভূষিতকরণ একদিকে, অপরদিকে আসমান-যমীনের যা কিছু আছে, যা মানুষ গোপন রাখে, যা প্রকাশ করে, এমনকি যেসব মানুষের অন্তরে গভীরভাবে প্রচ্ছন্ন – সে বিষয়ে অবহিত হওয়া এ সবই সেই আল্লাহ’রই করায়ত্ত। একদিকে বাস্তব কাজ অপরদিকে সর্ববিষয়ে জ্ঞান – এ দুটিরই একচ্ছত্র অধিপতি একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ বলেই তার এই ক্ষমতা। এই ক্ষমতা তার আছে বলেই তিনি আল্লাহ। আর এই আল্লাহ’র পক্ষেই সম্ভব বিশ্বলোক সৃষ্টি, বিশ্বলোক পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ। “আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারের বাস্তব ব্যবস্থাপনা তিনিই করেন ….” (সূরাহ আস-সাজদাহ, ৩২ : ৫) “তিনিই আল্লাহ – যিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত। তিনিই পরম দয়াবান ও করুণা নিধান। তিনিই আল্লাহ – তিনি ছাড়া কেউ মাবুদ নেই। তিনিই মালিক, বাদশাহ, অতীব মহান পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থাপক, সংরক্ষক, সর্বজয়ী, নিজ নির্দেশ-বিধান নিজ শক্তিবলেই কার্যকরকারী আর স্বয়ং বড়ত্ব অবলম্বনকারী। মহান পবিত্র আল্লাহ – লোকদের কৃত শিরক থেকে তিনি সম্পূর্ণই মুক্ত ও পবিত্র। তিনি আল্লাহ – তিনি স্রস্টা, সৃষ্টি পরিকল্পনা রচনাকারী ও তার বাস্তবায়নকারী এবং তদনুযায়ী রূপ ও আকার-আকৃতি দানকারী। তারই জন্য অতীব উত্তম নামসমূহ। আসমান-যমীনের সবকিছু তারই পবিত্রতা বর্ণনা করে। আর তিনিই তো মহাপরাক্রমশালী, দুর্জয়, মহাবিজ্ঞানী।” (সূরাহ আল-হাশর, ৫৯ : ২২-২৪) স্রস্টা আল্লাহ’ই। সৃষ্টিকর্ম কেবলমাত্র তারই কৃত। সৃষ্টি করার ক্ষমতা শক্তি ও যোগ্যতা পূর্ণমাত্রায় কেবল তারই রয়েছে। তিনি নিরংকুশ, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছিলেন, সে ইচ্ছাকে তিনি সৃষ্টিকর্মের প্রতি নিবদ্ধ করেছিলেন। ফলে এই বিশ্বলোকের পক্ষে অস্তিত্ব লাভ করা সম্ভবপর হয়েছিলো। তাই যেমন তিনি চেয়েছেন, সৃষ্টিটা সেভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। মাঝখানে কোন মাধ্যম বা সহায়কের প্রয়োজন দেখা দেয় নি। মাধ্যম বা সহায়ক হওয়ার সাধ্যও ছিলো না, নেই কারুরই। আল্লাহ’র সে ইচ্ছার নিগূঢ় তত্ত্ব কি, তা কারোই জানা নেই, কারো পক্ষে তা জানা সম্ভবও নয়। সে ইচ্ছা বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করলো কিভাবে, তা অনুভব করা মানবীয় ক্ষমতার বাইরে। এ তত্ত্ব গভীর নিগূঢ় তমসাচ্ছন্ন রহস্য। সে রহস্য জানার শক্তি মানুষের নেই। নেই এ কারণে যে, মানুষকে যে দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করা ও দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছে, সে দায়িত্ব পালনের জন্য এই শক্তির কোন প্রয়োজনই নেই। মানুষকে দেওয়া হয়েছে দুনিয়ার খিলাফতের দায়িত্ব, পৃথিবীকে মানুষের বাসোপযোগী করে বিনির্মাণের ও সুষ্ঠ পরিচালনার দায়িত্ব। প্রাকৃতিক নিয়ম-বিধানের সূক্ষ্মতত্ত্ব মানুষকে ততটুকুই জানতে দেওয়া জানার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার বেশী নয়। মানুষকে তার ব্যবহার ও প্রয়োগ করার ও এবং তা থেকে কল্যাণ লাভ করার ক্ষমতা যোগ্যতা দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু তার নিগূঢ় তত্ত্ব কি, তা জানার কোন উপায়ই মানুষের করায়ত্ত নয়। কেননা, খিলাফতের দায়িত্ব পালনের সাথে এই নিগূঢ় তত্ত্ব-জ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। তবু দুনিয়ার দার্শনিকরা সে তত্ত্ব রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন, সে বিষয়ে কোন না কোন ধারণা গ্রহণ করতেও হয়তো সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তা নিছক ধারণা (Speculation) মাত্র। তা সত্য হতেও পারে, নাও হতে পারে। তার উপর দৃঢ় আস্থা ও প্রত্যয় স্থাপন করা আর বলা যে, তা-ই একমাত্র সত্য, তার বিপরীত কথা সত্য নয়, কিছুতেই সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধারণা ও অনুমান হাস্যোদ্দীপকও হয়ে পড়ে। তখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, দার্শনিক হয়ে এমন হাস্যকর কথা কি করে বললেন ? কেননা এ দার্শনিকেরা মানুষের প্রকৃতিকে বদলে দিতে চেষ্টা করেছেন, তার শক্তি ও ক্ষমতার সীমা বেস্টনী অতিক্রম করে যেতে চেষ্টা করেছেন। ফলে মানুষের মনের স্বস্তিদায়ক কোন তত্ত্ব প্রকাশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে গ্রীক দর্শন যে সব তত্ত্ব প্রকাশ করেছে, তা সত্য নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়। উপরে উল্লিখিত কুরআন মাজীদের আয়াতসমূহ থেকে যে দার্শনিক মতটি গড়ে উঠে, তা হচ্ছে – সৃষ্টি স্রস্টা থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র সত্তাবান। স্রস্টা তুলনাহীন, সাদৃশ্যহীন। তার সৃষ্টি তার থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ইসলামে অদ্বৈতবাদ (Pantheism) এর কোন স্থান নেই। এই মতে মনে করা হয় যে, সৃষ্টি ও স্রস্টা অভিন্ন, একাকার। যা স্রস্টা তা-ই সৃষ্টি ! অথবা স্রস্টা নিজেই নিজেকে সৃষ্টির মধ্যে প্রতিফলিত করেছেন। সৃষ্টির মধ্যেই স্রস্টা স্থান গ্রহণ করেছেন ! স্রষ্টাকে সৃষ্টির মধ্যেই সন্ধান করো প্রভৃতি। কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে, স্রস্টা সৃষ্টির অস্তিত্ব দানকারী, সৃষ্টির বাইরে অবস্থিত। সৃষ্টির একমাত্র কাজ হছে স্রস্টার দাসত্ব করা, আনুগত্য হুকুমবরদারী করা। স্রস্টা ছিলেন, সৃষ্টি ছিল না। স্রস্টা সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলেন, তার এই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে সৃষ্টির অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে। তাই কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে – “…… আর যখন সৃষ্টিকর্তা কোন ব্যাপারের (সৃষ্টি কর্মের) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন তার কাজ হয় শুধু এই কথা বলা যে – ‘হও’, অমনি তা হয়ে যায়।” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১১৭) “যখন” বলতে বিশেষ কোন সময়কে বুঝায় না। কেননা, একে তো আল্লাহ সকল সময় কালের ঊর্ধ্বে, দ্বিতীয়ত, এ সেই সময়ের কথা যখন সময় কাল বলতে কিছুই ছিল না। অপর এক আয়াতে এই কথাটি বলা হয়েছে এই ভাষায়ঃ “কোন জিনিসকে অস্তিত্ব দানের ইচ্ছা করলে সেই জিনিসের প্রতি আমার শুধু এতোটুকু কথা বলাই যথেষ্ট যে – ‘হও’, তখন তা হয়ে যায়।” (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ৪০) অর্থাৎ, তার কোন ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য কোন সাজ সরঞ্জাম বা দ্রব্য-সামগ্রী, কোন কারণ, কোন নিমিত্ত আর অবস্থার কোন অনুকূলের মুখাপেক্ষী হোন না। তার প্রত্যেকটি ইচ্ছা শুধুমাত্র তার হুকুমেই বাস্তবায়িত হয়ে যায়। তার নির্দেশেই প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী সংগ্রহীত হয়ে যায়। কারণ ও নিমিত্ত গড়ে উঠে। তার নির্দেশেই তার ইচ্ছার অনুকুল অবস্থার সৃষ্টি করে। বর্তমানের এই বিশ্বভুবন কেবলমাত্র তার হুকুমেই অস্তিত্বমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, তার ইচ্ছা পূরণে ও নির্দেশ বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক কিছুই কোথাও নেই। “হও” – এরপর হয়ে যায়, বাহ্যত কথা দুটো হলেও আর একটি অপরটির উপর ভিত্তিশীল হলেও, মূলত তা একটিমাত্র জিনিস। এ পর্যায়ে এ বিতর্ক নিতান্তই অবান্তর যে, “হও” কথাটি বলা যায় বর্তমান থাকা কোন কিছুকে, কিন্তু এখানে বর্তমানে তো কিছুই নেই। আছেন কেবলমাত্র আল্লাহ, তিনিই এই আদেশের দাতা। আর যাকে এ আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা তো অস্তিত্বহীন (Non Existent)। কেননা, যা অস্তিত্বমান নেই বাহ্যিক দৃষ্টিতে, আল্লাহ’র ইচ্ছায় তা অস্তিত্বশীল। তাই তাকে প্রকাশমান বানিয়ে দেওয়ার জন্য “হও” বলা বিন্দুমাত্র অসঙ্গত ব্যাপার না। তবে এই বিশ্বলোক শাশ্বত ও চিরন্তন কিনা, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এই বিশ্বলোকের চিরন্তন ও শাশ্বত (Eternal) হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। কেননা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হচ্ছে, তাপ উত্তপ্ত বস্তু থেকে উত্তাপহীন বস্তুতে সংক্রমিত হয়। এর বিপরীতটা সম্ভব নয়। প্রদত্ত শক্তি (Energy) ও অপ্রদত্ত শক্তির মধ্যে আনুপাতিক সম্পর্ক পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বলোক পৌঁছে যাবে যখন সমগ্র অস্তিত্বের জগতে তাপমাত্রা সমান হয়ে যাবে। আর তা যখন হবে, তখন জীবনেও গতিশীলতার পক্ষে কল্যাণকর শক্তি অবশিষ্টই থাকবে না। তারই পরিনতিতে রাসায়নিক ও প্রাকৃতিক কার্যক্রম নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তার অনিবার্য পরিণতিতে জীবনের সব চিহ্নই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিঃশেষ ও বিলীন হয়ে যাবে। এক্ষণে জীবন বর্তমান, সক্রিয়। আর সে কারণেই তাপযুক্ত সত্তাও বর্তমান। এর দরুন রাসায়নিক ও পদার্থগত কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে বিশ্বলৌকিক বস্তু সৃষ্টির। এ থেকে এ কথা প্রকট হয়ে উঠে যে, এই বিশ্বলোক শাশ্বত নয়। আর যা শাশ্বত নয় তার শক্তি খুব বেশী বিলম্বে হলেও নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তার পরিণতিতে জীবনের স্পন্দন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাবে। আমেরিকান দার্শনিক এডওয়ার্ড লুথার ক্যাসেল বলেছেন, “বৈজ্ঞানিক তত্ত্বালোচনা প্রমাণ করেছে, এই বিশ্বলোকের একটা সূচনা আছে। তাতে স্রস্টার অস্তিত্বও প্রমাণিত হয়। কেননা, সূচনা সম্পর্ক কোন জিনিস নিজস্বভাবে সূচিত হতে পারে না, সে জন্য অনিবার্যভাবে একজন সূচনাকারী স্রস্টার প্রয়োজন।” স্যার জেমস জীনসও তাই বলেছেন তার বই “The Mysterious Universe” নামের বইতে। “তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশমান সর্ববিজয়ী, তিনিই অভ্যন্তরস্থ আর তিনিই সর্ববিষয়ে মহাজ্ঞানী।” (সূরাহ আল-হাদীদ, ৫৭ : ৩) তিনিই প্রথম – অর্থাৎ, তিনি সব কিছুরই পূর্বে ছিলেন, সব কিছু নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পরও থাকবেন। এই বিশ্বালোক বা সৃষ্টিলোক বলতে যেখানে যা আছে, তা কিছুই যখন ছিল না, তখনো তিনি ছিলেন। আর এক সময় যখন এর কিছুই থাকবে না, সব কিছুই ধ্বংস ও নিঃশেষ হয়ে যাবে, তখনো তিনি থাকবেন। কেননা, তিনিই একমাত্র শাশ্বত সত্তা। তিনি সময় কালের হিসাবের ঊর্ধ্বে। যখন এই সময় কাল সূচিত হয়নি, সময় কালের হিসাব বা গণনারও কিছু ছিল না, তখনো তিনি স্ব-সত্তায় মহিয়ান হয়ে ছিলেন। আবার যখন সময়কালের গতিপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে যাবে, বিশ্বলোক ও সৃষ্টিলোকের সব কিছুই চূর্ণ-বিচূর্ণ, ধ্বংস এবং নিঃশেষ ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখনো তিনি স্বীয় মহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন। তার নিজের শেষ বা সূচনা নেই, নেই কোন পরিসমাপ্তি। মর্যাদায় তিনি যেমন সর্বোচ্চে, সক্রিয়তায়ও তিনি সর্বাগ্রে। তার সত্তা কোন কাল বা সময়ের আওতার মধ্যে নয়, সময় কালের হিসাবের মধ্যে পড়ে না তার সত্তা ও সক্রিয়তা। কেননা তিনি অন্যান্য সবকিছুর মতো সময় ও কালেরও স্রস্টা। সময় ও কাল তারই সৃষ্টি। তাই সৃষ্টির উপর স্রস্টার অগ্রবর্তীতা ও পূর্ববর্তিতা কিছুমাত্র দুর্বোধ্য বা অমানুমেয় নয়। পরন্ত সবকিছুই যখন নিঃশেষ হয়ে যাবে, তখন সময় কালের গতি ও হিসাবও স্তব্ধ হয়ে পড়বে। কিন্তু তার সক্রিয়তা থেমে যাবে না। তিনিই প্রকাশমান – অর্থাৎ, বিশ্ব চরাচরের যেদিকেই তাকানো যায়, সে দিকেই স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায় তার অসীম ক্ষমতা ও সক্রিয়তার বাস্তব লক্ষণ। কেননা যা কিছুই গোচরীভূত হয়, তা আছে বলেই গোচরীভূত হয়। আর আছে এজন্য যে, তিনিই সেই জিনিসকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। তা সবই সৃষ্ট ও নশ্বর, তাই স্রস্টা অবিনশ্বর, তার উপর বিজয়ী, কর্তৃত্বশালী ও নিয়ন্ত্রণকারী। সৃষ্টিই স্রস্টার অস্তিত্বের অকাট্য ও অনস্বীকার্য প্রমাণ। সে সাথে সৃষ্টির নশ্বরতা স্রস্টার অবিনশ্বরতার অনিবার্য ফল। সৃষ্টির একটা সময় ছিল, যখন তা সৃষ্ট হয়নি, অর্থাৎ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু স্রস্টা চির বর্তমান, চির অম্লান, চির ভাস্বর আর এ কারণেই তিনি এক, অনন্য। কেননা, এরূপ সত্তা একাধিক হওয়া সম্ভব নয়। অতএব, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যে এক ও অনন্য, তা এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত। কিন্তু সে সাথে এ কথাও সত্য যে, মহান আল্লাহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন, তার মহান সত্তা না স্পর্শ করা যেতে পারে, না দেখা যেতে পারে এই দুনিয়ায় মানুষের এই চোখ দিয়ে। “…. তিনি ছাড়া সত্যই কোন ইলাহ নেই, সবকিছুই ধ্বংসশীল – কেবল তার মহান সত্তা ব্যতীত, সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্ব কেবলমাত্র তারই এবং তোমরা সকলে তারই কাছে ফিরে যেতে বাধ্য।” (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮ : ৮৮) “প্রত্যেকটি জিনিসই যা এই জগতে রয়েছে অবশ্যই ধ্বংসশীল ও বিলিয়মান। কেবলমাত্র তোমার মহীয়ান গরিয়ান রব – এর পবিত্র সত্তাই চিরন্তন হয়ে থাকবে।” (সূরাহ আর-রহমান, ৫৫ : ২৬-২৭) “…… প্রত্যেকটি সময়ই তিনি নবতর ভিন্নতর অবস্থায় অবস্থান করেন।” (সূরাহ আর-রহমান, ৫৫ : ২৯) অর্থাৎ, আল্লাহ’র মহান সত্তা চিরন্তন, শাশ্বত। তিনি চিরদিন ছিলেন, চিরদিন আছেন, চিরদিনই থাকবেন। ধ্বংস বা বিলুপ্তি থেকে তিনি চির মুক্ত ও চির ঊর্ধ্বে। তিনি ছাড়া এই বিশাল জগত যেহেতু সৃষ্ট, নতুন করে অস্তিত্বপ্রাপ্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া একান্তই অবধারিত অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী। এই বিশ্ব কর্মক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তার সীমাহীন কর্মক্ষমতাকে সদা কার্যকর করে রেখেছেন। তার এই কর্মতৎপরতার একটি শেষহীন সীমাহীন ধারাবাহিকতা অব্যাহত ধারায় চলছে। তিনি কাউকে জীবন দিচ্ছেন, কারো জীবন শেষ করে দিচ্ছেন। কাউকে ঊর্ধ্বে তুলছেন, কাউকে নিচে ঠেলে দিচ্ছেন। কাউকে রোগাক্রান্ত করছেন, কাউকে নিরাময়তা দান করছেন। কোন নিমজ্জিতমানকে উপরে ভাসিয়ে তুলছেন, কোন ভাসমানকে ডুবিয়ে মারছেন। সীমা সংখ্যাহীন সৃষ্টিকুলকে তিনি রিযক দিচ্ছেন, সীমাসংখ্যা পরিমাণহীন দ্রব্য সম্ভাব তিনি নিত্য নতুনরূপে ও গুণে, আকারে ও আকৃতিতে তৈরি করছেন। অন্যদিকে এসব কিছুকে তিনি আবার ধ্বংসও করছেন। তার সৃষ্ট এই বিশাল জগত একই অবস্থায় স্থিতিশীল হয়ে থাকছে না। বিশ্ব প্রকৃতিতে যেমন চলছে নিত্য নতুন নির্মাণ প্রক্রিয়া, তেমনি চলছে ধ্বংস বিলয়, ভাঙন ও বিপর্যয়। কোথাও ভুমিকম্পে স্থলভাগে চলছে ভূমিধ্বস, কোথাও মহাসমুদ্রের অতল গহবর থেকে জেগে উঠছে নতুন নতুন দেশ, মহাদেশ। এই জগতের অবস্থা প্রতিটি মুহূর্তই পরিবর্তনশীল। মহান স্রস্টা প্রতি মুহূর্ত তাকে এক নতুন রূপে ও সজ্জায় সাজিয়ে তুলছেন। তা যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি ক্রমঃবিকাশমান। বিশ্ব জাহানের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও মহান আল্লাহ স্ব-শক্তি, স্ব-কুদরাতে ও স্বীয় গুণপরিচিতিতে চিরকালই অক্ষয় অব্যয় অম্লান হয়ে থাকবেন। সৃষ্টিকুলের ধ্বংসের কোন প্রতিক্রিয়াই তার সত্তাকে ক্ষুণ্ণ করবে না বিন্দুমাত্রও। তাই অপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ “তোমাদের কাছে যা আছে তা সব ফুরিয়ে যাবে, আর আল্লাহ’র কাছে যা আছে তা সবই যথাযথ স্থায়ী হয়ে থাকবে ….” (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ৯৬) (এখানে কয়েক লাইনের ছোট্ট একটি প্যারা বাদ দিয়েছি এ কারণে যে, আকিদাগতভাবে সংশ্লিষ্ট এ বক্তব্যের দলীল আমার জানা নেই, তাই আমি এটা উপস্থাপন করছি না। আল্লাহ’ই সবচেয়ে ভালো জানেন।) হাদিসে আল্লাহ’কে লক্ষ্য করে এ বাণীটি উদ্ধৃত হয়েছেঃ “হে আল্লাহ, আপনিই সবকিছুর উপর প্রকাশমান, বিজয়ী ও সর্বোচ্চ, অতএব আপনার উপরে কিছু নেই, কেউ নেই।” আল্লাহ বাতিন – অন্তর্নিহিত প্রচ্ছন্ন সবকিছুই তার কাছে উদঘাটিত, প্রকাশিত। তার নিকট থেকে গোপন কিছু নেই, থাকতে পারে না। সমস্ত জিনিস ও ব্যাপারের অন্তর্নিহিত নিগূঢ় রহস্য তার আয়ত্তাধীন। তার এই সীমা পরিসীমা ও কূল কিনারাহীন জ্ঞানকে কেউই আয়ত্ত করতে পারে না। তার নিগূঢ় তত্ত্ব সমূহও কেউ জানতে পারে না। যেমন অপর এক আয়াতে আল্লাহ’কে লক্ষ্য করে বলা হয়েছেঃ “….. আপনি অনেক বেশী জানেন আমার মনের কথা, কিন্তু আমি তো জানি না আপনার মনের কথা …..” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১৬) বলা হয়েছেঃ “….. আর তিনিই অন্তর্নিহিত সববিষয়ে সর্বাধিক অবহিত।” (সূরাহ আল-হাদীদ, ৫৭ : ৬) দিল বা মন মানুষের। তাতে নানান সময় নানান কথার উদয় হয়। নানান চিন্তা বিশ্বাস বা মূল্যবোধের সঞ্চার হয়। মানুষ অনেক সময় নিজেও ঠিক বুঝতে পারে না তার মনের অবস্থা। কিন্তু আল্লাহ সেই সব বিষয়ে পূর্ণমাত্রায় অবহিত থাকেন। “আমরা প্রত্যেকটি জিনিস একটি পরিমাণ সহকারে সৃষ্টি করেছি। আর আমাদের সিদ্ধান্ত একটি একক ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই হয়ে থাকে ….” (সূরাহ আল-কামার, ৫৪ : ৪৯-৫০) অর্থাৎ, আল্লাহ’র এই সৃষ্টিলোকের কোন জিনিসই বিশৃঙ্খল ও অপরিমিতভাবে সৃষ্টি হয়নি। প্রত্যেকটি জিনিসেরই একটি তাকদির – একটি সামগ্রিক পরিমাণ নির্ধারণ রয়েছে। তদনুযায়ীই একটি বিশেষ সময় তা অস্তিত্ব লাভ করে, একটি বিশেষ রূপ ও আকার-আকৃতি গ্রহণ করে, একটি বিশেষ পরিমাণ পর্যন্ত তা প্রবৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে, একটি বিশেষ মেয়াদ পর্যন্ত তা অবশিষ্ট থাকে আর একটি বিশেষ সময়ে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। এই বিশ্ব ব্যাপক ও সর্বাত্মক (Universal) নিয়ম-পদ্ধতি অনুযায়ী আল্লাহ’র এই মহাসৃষ্টিকর্ম অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে, তা অব্যাহতভাবে চলবে, চলতে থাকবে, যদ্দিন তিনি তা চালাতে চাইবেন। আর যখন তিনিই তা শেষ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তখন তা নিঃশেষ ও স্তব্ধ হয়ে যাবে। এই বিশ্বলোক অনাদিও নয়, আর অবিনশ্বরও নয়। তা চিরকাল ছিল না যেমন, তেমনি চিরকাল থাকবেও না। এই হচ্ছে সমগ্র বিশ্বলোকের তাকদীর। গ্রন্থপঞ্জিঃ ১. আল কুরআনুল কারীম ২. তাফহীমুল কুরআন ৩. তাফসীরে কাবীর ৪. তাফসীর আল-মারাগী ৫. তাফসীর মাহাসীনুত-তাবীল ৬. الظو اهرالجغرا فية بين العلم والقران ৭. The Mysterious Universe ৮. তাফসীর আল-মীযান সূত্রঃ স্রস্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব (মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম রাহিমাহুল্লাহ)
Cash On Delivery
7 Days Happy Return
Delivery Charge Tk. 50(Online Order)
t

এই লেখকের আরো বই