চাঁদের বুড়ির বয়স যখন ষোলো (হার্ডকভার)

সংবাদপত্রে যশোর রণাঙ্গন

    ইতিহাসের পুনঃপাঠ: সাংবাদিকরা চলমান সময়ের ইতিহাস লিখেন। বিদ্বৎজন এমনও মনে করেন : ইতিহাস হলো বর্তমান, কারণ অতীত ঘটনাগুলোই বর্তমানে ইতিহাস হিসাবে অধ্যয়ন করা হয়। ইতিহাসের উদ্দেশ্য হলো বর্তমানের সাথে অতীতকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। এ জন্যই বুঝি ইতিহাসের পুন:পাঠ জরুরী। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। দেশটির জন্ম ইতিহাস ধূসর অতীত নয়। যারা এই ইতিহাস সৃজন করেছেন, তাঁদের অনেকেই এখনও জীবিত এবং প্রখর স্মৃতি থেকে অবলীলায় স্পষ্ট করে সব বলতে পারেন। একজন পেশাদার সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে এই প্রামাণ্যের আলোকে ইতিহাসের সত্য তুলে ধরা। ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদ বা গবেষকগণ এর উপর ভিত্তি করেই ‘রচিবেন অমর কীর্তি গাথা’। সাংবাদিক সাজেদ রহমান সেই কাজটিই করেছেন। অত্যন্ত সচেতনভাবে তিনি পরিকল্পনা করেছেন। ভৌগলিকভাবে বেছে নিয়েছেন তাঁর অতি পরিচিত যশোহরকে, আর সময়কাল হিসেবে উত্তাল একাত্তরের দিনগুলি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নানা কারনে যশোহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে মিত্র রাষ্ট্র ভারতের সাথে যোগাযোগের করিডোর হিসেবেই যে যশোহর ভূমিকা রেখেছে তাই নয়, বাংলা নামে দেশটির জন্ম ইতিহাসের কোন কোন ঘটনার প্রথম প্রত্যক্ষ সাক্ষী যশোহর। অবস্থানগত কারনে ১৯৭১ সনে যশোহর হয়ে ওঠে সাংবাদিকদের যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ দেখার প্রথম জানালা। এই জানালা দিয়ে তাঁরা যা দেখেছেন তা’ আসলে যুদ্ধকালীন গোটা বাংলাদেশেরই চিত্র। সাজেদ রহমান বলছেন : বিদেশী প্রচার মাধ্যমে যশোহর এলাকা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল তার অবস্থানগত কারণে। লড়াই শুরু হওয়ার আগেই যশোহরের নিয়ন্ত্রণ নেন মুক্তিকামী মানুষ। কলকাতার পত্র-পত্রিকাগুলো পূর্ব বাংলার খবর প্রচারে যশোহরের পরিস্থিতিকেই সামনে রাখেন, কারন পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকা ছিল প্রায় অসম্ভব। ওইসময় প্রায় প্রতিদিনই কলকাতা থেকে ৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সাংবাদিকরা আসতেন বেনাপোল চেকপোষ্ট লাগোয়া ভারতীয় এলাকা হরিদাশপুরে। ভারতীয় সাংবাদিকরা ছাড়াও সে সময়ের ‘ব্যাটেলগ্রাউণ্ড বাংলাদেশ’ কভার করতে আসেন যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানির বহু দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমের খ্যাতিমান যুদ্ধ সাংবাদিকরা। আসলে তাঁদের মাধ্যমেই বিশ্ব জানতে পারে কি ঘটছে বাংলাদেশে। যশোহর শহরের পতন ঘটে। ১৯৭১ সনের ৪ এপ্রিল, মুক্তিযোদ্ধারা বেনাপোল ত্যাগ করেন ১৯ মে। ফলে, ২৬ মার্চ থেকে এ সময়কাল পর্যন্ত অসংখ্য সাংবাদিক যশোহর শহর এবং বেনাপোলসহ অন্যান্য মুক্ত এলাকা ঘুরে রিপোর্ট করেন, আলোকচিত্র ধারন করেন। প্রবল ঝুঁকি নিয়ে এই যে যুদ্ধচিত্র সাংবাদিকরা এঁকেছিলেন, চলমান সময়ের যে ইতিহাস তারা সেসময় লিখেছিলেন তা’ এতদিন ছিল সংবাদপত্রের পাতায় বা সংবাদ মাধ্যমের নথিতে। সাংবাদিক সাজেদ রহমান সাহসী ও পরিশ্রমী পরিকল্পনা নিয়ে এসব প্রামাণ্য নিয়ে এসেছেন দুই মলাটের ভেতর। লক্ষ্য সেই ইতিহাসের পুনঃপাঠ। এই প্রামান্য গ্রন্থটিতে তিনি শুধু ১৯৭১ সনের ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম নয়, বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যমের খ্যাতিমান সংবাদকর্মীর কাজও তুলে ধরেছেন। এক সময় যা’ ছিল শুধু খবর মাত্র আজ তাই ইতিহাসের অংশ। এসব পাঠ করে আজও শিহরিত হই। গ্রন্থটি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয় কিন্তু যশোহর অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ কালের মাটি কামড়ানো সত্য। সাজেদ রহমানের সংগৃহীত আধেয় নিয়ে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদ বা গবেষকদের জন্য আঁকর গ্রন্থ হিসেবে অতি প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই গ্রন্থটির গুরুত্ব অনেক বেশি অন্য আরেকটি কারণে। বাংলাদেশের মানুষকে যেসব কারনে সমালোচনা করা হয় তার অন্যতম বাঙালী বিস্মৃতি প্রবণ। তারা দ্রুত সব ভুলে যায়। হয়তো কথাটিতে অতিশয়োক্তি আছে। তবে বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন কালে প্রত্যক্ষ করছি ভিন্ন এক বাস্তবতার। এই বাস্তবতা বিস্মৃতির চাইতেও ভয়ংকর। সেটি হচ্ছে, ভুলিয়ে দেয়ার শুধু নয়, ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার সংস্কৃতি। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র পঞ্চাশ বছরের মাথায় এই ভুলিয়ে দেয়া বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজটি এত পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বা হচ্ছে যে তা’ নতুন প্রজন্মের সাথে কথা বলেই বুঝা যায়। কারা কি কারনে এই কাজটি করেছে বা করছে তা’ ভিন্ন আলোচনার প্রসঙ্গ। এই বাস্তবতার সামনে সাজেদ রহমানের কাজটি একজন পেশাদার সাংবাদিকের অসামান্য কাজ বলেই মনে করি। তিনি একেবারে প্রাথমিক সূত্র থেকে তুলে এনেছেন ইতিহাসের প্রামান্য। নিজে ইতিহাস লিখেননি কিন্তু ইতিহাসের সত্য নতুন করে তুলে এনেছেন সবার সামনে। একজন সাংবাদিকের মূল দায়িত্ব : মানুষকে প্রকৃত তথ্য জানানো এবং এই তথ্য জানানোর মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা। বলাই বাহুল্য, সাংবাদিক সাজেদ রহমান সেই মৌলিক দায়িত্বটি পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। মূল এবং প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রের কাছ থেকে তুলে আনা এই প্রামাণ্য তথ্য শুধু আমাদের সত্যের মুখোমুখিই দাড় করাবে না, এই সত্য ভুল ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর যে অপতৎপরতা তার সামনেও প্রামানিক সত্যের দেয়াল হিসেবে দাঁড়াবে, রক্ষা করবে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া আমাদের নতুন প্রজন্মকে। সাংবাদিকতায় একই সাথে মেধা ও পরিশ্রম হাত ধরাধরি করে চলে। সাজেদ রহমানের এই অসামান্য কাজটিতে তার প্রতিফলন দেখতে পাই। তাঁর গ্রন্থে কলকাতার এক সময়ের প্রধান বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘যুগান্তর’, ‘দৈনিক কালান্তর’, ইংরেজি ‘দি স্টেটসম্যান’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’সহ, নতুন দিল্লির ইংরেজি পত্রিকা ‘টাইমস অব ইণ্ডিয়া’ এর মত যে সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের নাম দেখতে পাই তার অনেক গুলোই এখন আর প্রকাশিত হয় না। সেই সব হারিয়ে যাওয়া সংবাদ মাধ্যম বা এখন যেগুলো প্রকাশিত হয় সে সবের আর্কাইভ ঘেঁটে ইতিহাসের সত্য বের করে আনা কতটা আয়াসসাধ্য তার মাপ করা কঠিন। মেধার সংযোগ না হলে এই পরিশ্রম পুরোটাই হতো পণ্ডশ্রম। কিন্তু সাজেদ রহমান সাফল্যের সাথে ইতিহাসের এমন সব মুক্তো তুলে এনেছেন, পঞ্চাশ বছর আগে যা’ ছিল একটি স্বাধীন দেশের জন্মের শিহরন জাগানো চলমান ইতিহাসের অংশ। সেই মুক্তোর উজ্জলতায় আলোকিত হবে আমাদের নতুন প্রজন্ম সেটাই প্রত্যাশা। শুধু সংবাদ মাধ্যম নয়, সাজেদের গবেষণায় দেখি অনেক সাংবাদিকের নাম, যারা কঠিন একসময়ে সব চ্যালেঞ্জ পায়ে দলে পালন করেছেন পেশাদারী দায়িত্ব। পেশার প্রতি কি অপরিসীম প্রেম নিয়ে সেই কঠিন সময়ে এই অকুতোভয় মানুষগুলো দায়িত্বপালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে সেও এক বিস্ময়। এই মানুষ গুলো শুধু ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী নন, তাঁরা শুধু ইতিহাস লেখেননি বস্তুত তাঁরাও হয়ে গেছেন ইতিহাসের অংশ। সাজেদ রহমানের এই গ্রন্থনা তাঁদের প্রতি সেই সম্মাননাও জানাচ্ছে। গ্রন্থটি ইতিহাসের প্রামান্য দলিল হিসেবে একটি অসাধারন গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত হবে এ বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই। মেধাবী ও পরিশ্রমী সাংবাদিকদের সামনে এই কাজটি হবে অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত। সাজেদকে ধন্যবাদ এই অসামান্য কাজের জন্য। তাঁর এই ইতিহাসের পুনঃপাঠের আয়োজন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের কাছে। - মনজুরুল আহসান বুলবুল ঢাকা, ২০ জানুয়ারী ২০২২
Cash On Delivery
7 Days Happy Return
Delivery Charge Tk. 50(Online Order)
সাজেদ রহমান:
সাজেদ রহমানের জন্ম ১৯৬৯ সালের ১৫ মে শার্শার শালকোনা। পড়াশোনা গাঁয়ের সিববাস শালকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক পাকশিয়া হাই স্কুল থেকে। ডাক নাম বকুল।
পিতার নাম শহীদ সোহরাব উদ্দীন। মাতা খায়রুন নেছা। দুই ভাই ছয় বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। তার বড় ভাই শহীদ সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল। সাজেদ রহমান ১৯৯৮ সালে সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স পাস করেন।

দৈনিক বাংলায় ফিচার লেখালেখির মাধ্যমে তিনি সংবাদপত্র জগতে প্রবেশ করেন। ২০০০ সালের ১ আগস্ট থেকে তিনি দৈনিক জনকন্ঠে স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত রয়েছেন।
মূলত সাংবাদিকতা নয়, অন্য পেশায় থিতু হবার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু ভাই সাংবাদিক শামছুর রহমান সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হলে তিনি এই পেশায় চলে আসেন।
তিনি যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের চার বারের সভাপতি এবং (বিএফইউজে) বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের খুলনা বিভাগীয় যুগ্ন মহাসচিব ও সহ সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ভ্রমণ তার শখ। বই পড়ে এবং গান শুনে সময় পার করতে তিনি পছন্দ করেন।

এই লেখকের আরো বই