চাঁদের বুড়ির বয়স যখন ষোলো (হার্ডকভার)

একজন আলি কেনানের উত্থান পতন

    একজন আলি কেননের উত্থান পতন-আহমদ ছফা দে তোর বাপরে একটা ট্যাহা। ভিখিরিরা সাধারনত ভক্ষাদাতাকেই বাবা বলে ডাকে। আলি কেনানা দাবি ছেঢ়ে বসলো সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ সে ভিক্ষাদাতার বাবা এবং একটা টাকা তাকে এখখুনি দিয়ে দিতে হবে। একেবারে যাকে বলে কড়া নির্দেশ। এই চাওয়ার মধ্যে রিতিমতো একটা চমক আছে। এভাবেই উপন্যাসের শুরু। একজন নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষ যার নাম আলি কেনানা। এই নির্দেশের মধ্যই সে খুঁজে পায় তার আত্ববিশ্বাস,সে বুঝে যায় ভাল করে নির্দেশ দিতে পারলে যে কেউই তা পালন করতে বাধ্য। অধিকাংশ মানুষের মনের জোর থাকে খুব কম। সব সময় থাকে একটা আস্থাহীনতার ভয়। হঠাৎ টিকটিকির ডাকের শব্দে যেমন ভয়ে চমকে উঠতে হয় গঠনাটি অনেকটা এরকমই। "একজন আলি কেনানের উত্থান পতন" নাম করন থেকেই ধারনা করা যায় এর কেন্দ্রিয় চরিত্রে আছে আলিকেনান নামে একজন । আহমেদ ছফা খুবই বাস্তাব ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন এই আলি কেনানাকে। যেমন করে আমাদের চারপাশের মানুষের রাতারাতি উত্থান হয় এবং পতনও ঘটে তাদেরই একজন এই আলি কেনান। ভোলা জেলার একটি ছোট মহকুমা শহর। পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁ একদিন মিটিং করতে গিয়ে নৌকায় গ্রামবাসি দের আক্রমনের শিকার হন। তার তাবেদারা তাকে ফেলে পালায়। আলি কেনান সেই নদীতেই মাছ ধরতে ছিল।গভর্নরের জীবন বাঁচিয়ে আলি কেনান হয়ে যায় গভর্নরে একান্ত পিওন। নামে পিওন হলেও তার ক্ষমতা ছিল প্রায় ঈশ্বরের কাছা কাছি। মন্ত্রি, এমপি দেরকেও তার কথা শুনতে বাধ্য করতেন। গভর্নরের পরেই যার এত ক্ষমতা হঠাৎ তার পতন হয়। স্বর্গ থেকে আদমের পতনের মতো একেবারে মাটিতে। আলি কেনান ভিখারির গোত্রেয় হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু আলি কেনন আবার শুরু করেন জীবন। একেবারে অন্য প্রান্ত থেকে। আবার মাটি থেকে স্বর্গে যাত্রা। নিজেকে আলখেল্লায় জড়িয়ে পীর সেজে গড়ে তুলেন তার নতুন সম্রাজ্য। খুব সতর্কতারসহিত জৌলুস বাড়াতে থাকেন তার সিংহাসনের। সেবকের সাথে সাথে সেবা। গরিব শিশ্যদের সাথে সাথে আসতে থাকে ধনিরা সেই সাথে ধনেরাও। কিন্তু শেষ বিপর্যয়ের হাত থেকে সে রক্ষা পায়নি। দৃঢ়চেতা, সাবধানি,চতুর হওয়ার কারনে তার চরত্রটি অন্য পীর ফকিরদের সাথে মলিন হয়ে মিশে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচান উপন্যাসিক।যদিও কৌশল গতদিক থেকে আর দশটা পীর ফকিরদের সাথে তার পার্থক্য সামন্যই।তিনিও ভন্ডামির দ্বারা ঠিকিয়েছেন সাধারনকে। সেও স্বপ্নে অলৌকিক দর্শনের দাবি করেছেন। মানুষকে ধোকা দেবার জন্য পীররা কেউ ঈশ্বর,কেউ তার প্রতিনিধী। কেও কেও সুফি আলেম দরবেশ বাবা দের। হতে পারে পীর বাবারা নিজেদের অস্তত্ব রক্ষার জন্য এমন একজনের সাক্ষাত পান যার অস্তিত্ব কখনো ছিলই না। জিবীত পীররা তাদের চিন্তা, চেতনা দিয়ে তাদের কে করেছে মহামান্মিত। আলি কেনান এমনই তৈরি করেছেন"বাবা বু আলি কলন্দর" কে। আলি কেনানের শিশ্যদের কাছে এই বাবা ব আলি কলন্দর আসীম ক্ষমতাধর প্রায় ঈশ্বর তুল্য পীর। এমনকি হতে পারে যে আমাদের দেশের যে সকল মাজারের বিক্ষাত মানুষজন তারাও তাদের পরবর্তি প্রজন্মের কল্পনা আর মিথ দ্বারা সৃষ্টি?? একন কর্মঠ আত্মবিশ্বাসি চরিত্র তৈরি করতে আহমেদ ছফা কোন কৃপনতা করেন নি। তাকে বলিষ্ঠ স্বাস্থের আধিকারী করেছেন। যেমন করা হয়েছিল সকল নবী,ও ধর্মগুরুদের। কন্ঠস্বর দিয়েছেন তেজস্বি বুদ্ধি দিয়েছেন আমাদের দেশের রাজনীতি বিদদের মতো। কূট কৌশলে তাকে করেছেন বাস্তবের সাথে মিলে যাওয়া মানুষের মতো। লোভ লালসা,যৌনতা সবই দিয়েছেন আবার নিয়ন্ত্রন করেছেন বাস্তবতা ও সময়ের তাল মিলিয়ে। ধার্মিকদের দুর্বলতার দিক গুলি উঠি আসছে ঢেউ এর মতো স্বাভাবিক গতিতে। আলি কেনান গালাগালি করতো আশ্রাব্য ভাষায় কিন্তু ভক্তদের কাছে তাও শ্রুতিমধুর মনে হতো। তার উদ্ভট আচরনকে দেখতো পরম করুনাময়ের হেয়ালী হিসেবে। ভক্তদের আদর যত্নে যখন মোটাতাজা হয়ে উঠলেন ভক্তরা তখন তার দেহে দেখতে পেত নূরের ঝলকানি।যখনর না খেতে খেতে স্বাস্থ ভগ্ন হয় তখন ভক্তরা বলে" খোদার প্রেমে দিওয়ানা স্বাস্থ দেখার সময় কোথায়। যখন ইসলামের গর্হিত কাজ করতো যেমন কুকুর নিয়ে ঘোরাফেরা লোকে বলতো কত উদার আমাদের বাবা। সেই কুকুর যখন লাথি দিয়ে রাস্তায় ফেলে আসে ভক্তরা বলল কুকুর নাপাক প্রাণী। মাজার কে কেন্দ্র করে এই যে ব্যবসা,মাজারে কাজ করে তাদের ইতিবৃত্ত,উরুসের নামে টাকা কামানোর উৎসব। টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দখল বেদখল। রাজনীতিবিদদের সুবিধাবাদী আবস্থান। কবরকে কেন্দ্র করে মানুষের দর্বলতা সব কিছুই চমৎকার ভাবে উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। আহমেদ ছফার লেখার যে দিকটা আমার কাছে পছন্দের তা হলো লেখায় বর্ণনার ঢিলেঢালা ভাবটা থাকেনা। অনেকটা প্রবন্ধের ঢং কিন্তু জটিলতার দোষে দুষ্ট নয়। সহজ কথা তিনি সহজে বলেনই না সহজ করে বুঝিয়েও বলতে পারেন। একজন আলি কেনান উপন্যাসটা ব্যাপ্তির কারনেও এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়। এক্ষেত্র আমার ধারনা উপন্যাস শুরু করে দিলে উপন্যাসই পাঠককে দিয়ে পড়িয়ে নেয়। এটি ভাষার কারনেও হতে পারে আবার বলে যাওয়ার ধরনের কারনেও হতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন অস্তিত্ববাদী আলী কেনানের জীবনের উত্থান-পতন, এর সাথে সাথে আইয়ুব খান থেকে শেখ মুজিব-এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রায়-সমান্তরাল গল্প এই উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রকাশ করেছেন "খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি",প্রকাশ কাল ফেব্রুয়ারী২০০৪। প্রচ্ছদ করেন সমর মজুমদার। বইটি উৎসর্গ করা হয় চিত্তরঞ্জন সাহাকে।
Cash On Delivery
7 Days Happy Return
Delivery Charge Tk. 50(Online Order)
 আহমদ ছফা:

আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)  প্রতিবাদী লেখক, প্রগতিপন্থি সাহিত্যকর্মী ও সংগঠক। ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন  চট্টগ্রাম জেলার  চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। চট্টগ্রামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া সমাপ্ত করে ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

আহমদ ছফা ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী একজন সৃষ্টিশীল লেখক। ষাটের দশকে তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা হয়। সৃষ্টিধর্মী লেখক হিসেবে তিনি গল্প,  উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ,  শিশুসাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখান। তিনি বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য-সাময়িকপত্র সম্পাদনা করেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তিনি এক সফল লেখক। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প-উপন্যাস রচনায় কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর আখ্যানমূলক রচনায় বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, মুক্তিকামনা ও স্বাধীনতাস্পৃহা এবং সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র রূপায়িত হয়েছে।

সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭), উদ্ধার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান পতন (১৯৮৯), অলাতচক্র (১৯৯০), ওঙ্কার (১৯৯৩), গাভীবৃত্তান্ত (১৯৯৪), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬) আহমদ ছফার উপন্যাস এবং নিহত নক্ষত্র (১৯৬৯) তাঁর গল্পগ্রন্থ। কবিতায়ও আহমদ ছফার স্বতন্ত্রতা রয়েছে। জল্লাদ সময়, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমোবে এবার ইত্যাদি একাধিক কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা তিনি। অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশ, লোকজ ভাষা, পুথিপুরাণের শব্দ ও বাকরীতির প্রকাশ তাঁর কবিতার ধরণ হয়ে উঠেছে। জার্মান কবি গ্যেটের বিখ্যাত কাব্য ফাউস্ট-এর অনুবাদ এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের সংশয়ী রচনার বাংলা রূপান্তর আহমদ ছফাকে অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতি এনে দিয়েছে। অবশ্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবেই তাঁর পরিচিতি সর্বাধিক। আহমদ ছফার গবেষণার বিষয় ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজ। এ সমাজের গঠন, বিকাশ, জাগরণ ও প্রতিষ্ঠা এবং বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যা নিয়ে অন্যান্য চিন্তাবিদের মতো ছফাও গভীরভারে ভেবেছিলেন। ষাটের দশক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে জাতির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন। ছফার চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য রচনা বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭৩) ও বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৭৬)-এ।

এ দুটি বিশেষ চিন্তামূলক রচনাসহ দেশ, সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক নিবন্ধাবলি ছফাকে বাংলাদেশের  বুদ্ধিজীবী লেখকের মর্যাদাপূর্ণ আসন দিয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস অনুসন্ধানে ছফার আগ্রহ সবসময় পরিলক্ষিত হয়েছে এবং সে আগ্রহ থেকে তিনি লিখেছেন সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস; কিংবা প্রাজ্ঞ ও বহুদ্রষ্টা ব্যক্তির মননে সমাজ-প্রবাহের ঘটনাপুঞ্জ যে তাৎপর্যমন্ডিত হয় তার ইতিবৃত্তান্ত যদ্যপি আমার গুরু। ছফার রাজনৈতিক প্রবন্ধ এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিষয়ে রচনাও আছে। সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে তিনি বিভিন্ন সময়ে কলাম লিখেছেন এবং শেষের দিকে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির চলমান চিত্র ও সংবাদ বিষয়ে নানা নিবন্ধ লিখে সাহসী ও বিবেকী বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেন।

আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী। প্রগতির সংঘশান্তিতে তিনি আস্থাবান ছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিল প্রচুর। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আহমদ শরীফের নেতৃত্বে  বাংলাদেশ লেখক শিবির গড়ার মুখ্য ভূমিকাও পালন করেন তিনি। মুক্ত-স্বাধীন স্বদেশভূমিতে প্রগতির তরুণ সৈনিকদের অভ্যুদয় ছফার কাঙ্ক্ষিত ছিল। এজন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজে আরও মানববাদী সংগঠন গড়ে তোলেন কিংবা প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল সংগঠকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। তাঁর মৃত্যু ২০০১ সালের ২৮ জুলাই। 

এই লেখকের আরো বই